ইন্টেরিম সরকার এবং আমার ভাবনা- বাতেন মাহমুদ, ফেলো, ওয়াইপিএফ

অনেকের ভালোবাসাই একসময় টক্সিক হয়ে যায় ” অতি ভালোবাসার” কারণে।
অনেক বিপ্লব ব্যর্থ অতি বিপ্লবী ভাবনার কারণে।

ছাত্রদের ইন্টারিম সরকারের যে রুপরেখা দেখলাম তাতে মনে হইলো তারা পুরো দুনিয়া উলটে ফেলতে চায়। এই ধরনের ভাবনা সৎ কিন্ত অবাস্তব। অবাস্তব সৎ চিন্তাও বাস্তবের অসৎ চিন্তার কাছে পরাজিত হয়। তাই প্রয়োজন সুচিন্তিত ও কি করতে পারবো -সেই বাউন্ডারী নির্ধারণ করা।

একটা অনির্বাচিত জাতীয় সরকার যদি ৩-৬ বছরের সময় সীমা নেয় তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো সেটা মানবে না বলে আমার মনে হয়। এবং তাদের সেই না মানাটা যৌক্তিক। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি যারা করে তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যই ক্ষমতায় যাওয়া এবং নিজের নীতি বাস্তবায়ন করা। এখন যদি সব নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব ইন্টারিম সরকার নিয়ে নেয় তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর যে এজেন্সি এবং অথরিটি দুটোই অবজ্ঞা করা হবে। এই অর্থে এটাও অগনতান্ত্রিক চিন্তা।

ছাত্র আন্দোলন ও এর পরবর্তী অভ্যুত্থান কোন নীতি কিংবা লক্ষ্যকে সামনে রেখে হয়নি। এটা স্পন্টেনিয়াস ও রিয়েকটিভ রেভ্যুলেশন। মানে শাসকরা একটার পর একটা ভুল করেছে আর বিপরীতে আন্দোলন ‘চাকুরীর কোটা” থেকে দ্রুততম সময়ে পরিবর্তন হয়ে “সরকার পতন” আন্দোলনে চলে গেছে। তাই এই আন্দোলন পরিকল্পিতভাবে দেশ পরিবর্তনের আন্দোলন ছিলো না। এটা ছিলো কিছু অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ। এই বাস্তবতা আন্দোলনকারীদের নেতৃত্ব বুঝতে হবে।।অনেকেই এখন তাদের পানি পড়া দিয়ে অতি বিপ্লবী সাজাচ্ছে। অরাজনৈতিক শক্তি হয়েও তাদের সামনে রেখে র‍্যাডিকাল রিফর্মের স্বপ্ন দেখছে। আমার রাজনৈতিক জ্ঞান বলে এইগুলো বুমেরাং হবে।

যেসব অভ্যুত্থান একটা পলিটিকাল আইডিওলজিকে সামনে রেখে হয়, কিছু ঘোষিত নীতিকে সামনে রেখে হয় তাদের ম্যান্ডেট থাকে অভ্যুত্থানের পর সেসব নীতি বাস্তবায়ন করার। কিন্ত এই ছাত্র- জনতা অভ্যুত্থান সেভাবে হয়নি। আন্দোলনের কোন পর্যায়ে কোন দাবীতে সংবিধান সংষ্কার, রাষ্ট্র ক্ষমতা কাঠামো সংষ্কার, ক্ষমতায় যাওয়া এমন দাবী ছিলো না। তাই এখন এইসব দাবী করার মোরাল ম্যান্ডেট তাদের আছে কিনা? তাদের বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছে সেইটার প্রতিবাদে জনগন তাদের সাথে একাত্ম ঘোষণা করেছে। কিন্ত সংবিধান সহ নানা মৌলিক বিষয় পরিবর্তনের ঘোষনা দিয়ে জনগনের ম্যান্ডেট তো তারা নেয়নি। তাই এই ধরনের ম্যান্ডেট তাদের আছে, এইটা ধরে নেয়া একধরনের অগনতান্ত্রিক ভাবনা।
আমরা মোটামুটি অনেকেই ফিল করি স্বাধীনতার পর আমাদের প্রতিষ্ঠান সেভাবে গড়ে উঠে নাই।।যা ছিলো তাও পনের বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই আমাদের প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে। আইন পরিবর্তন দরকার। কিন্ত এগুলো সবই পলিটিকাল ইস্যু। এবং প্রথাগত রাজনৈতিক দলের কাজ। যারা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগনের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যাবে তারাই নীতি বানাবে।। কারণ গনতন্ত্র মানেই হচ্ছে ” আমার প্রতিনিধি” আমার জন্য আইন বানাবে সেই অনুমতি দেয়া। এখন নির্বাচন ছাড়াতো আমি প্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ পাচ্ছি না।।তাহলে রাষ্ট্রের মৌলিক আইন পরিবর্তনে জনগনের অংশগ্রহনের সুযোগ তো থাকলো না। তাই আইন বানানো কি কয়েকজন অনির্বাচিত উপদেষ্টার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে গনতান্ত্রিক রীতিতে?

আমি মনে করি– যে প্রকারেই হোক যেহেতু আমরা একটা এক্সট্রাঅর্ডিনারী সিচুয়েশেনের মধ্যে আছি, তাই যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে তাদের মৌলিক কাজ হওয়া উচিত তিনটা– প্রথমেই আইন শৃং্খলা পরিস্থিতি রিস্টোর করা।।দ্বিতীয়ত আইনের শাসনের প্রয়োগ কিভাবে হবে সেটার একটা “ডেমো” দেখানো আর তৃতীয়ত একটা সুন্দর নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা দ্রুততম সময়ের মধ্যে। এরপর নির্বাচিত হয়ে যে দল ক্ষমতায় আসবে তারা সংবিধান সহ বাকি মৌলিক আইনগুলো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করবে। এটাই গনতান্ত্রিক নিয়ম।

রাজনৈতিক দলের কাজ অরাজনৈতিক উপদেষ্টারা করলে দল ক্ষমতায় এসে কি করবে? গনতান্ত্রিক কালচারে ক্ষমতা মানে নীতিগত ক্ষমতা।।অর্থাৎ আমি এই নীতি বাস্তবায়ন করবো সেটা জনগনের কাছে নির্বাচনের আগে প্রকাশ করে তাদের সমর্থন চাওয়া।

এখন এই ছাত্র শক্তি যদি সংবিধান পরিবর্তন করতে চায় তাহলে তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করুক।।তারপর যে নির্বাচন হবে সেই নির্বাচনে ভোট চাক জনগনের কাছে। তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে সংবিধান পরিবর্তন সহ আরো মৌলিক কি কি পরিবর্তন তারা করতে চায় সেই পয়েন্ট গুলো থাকুক। তারপর জনগন তাদের নির্বাচিত করলে তাদের তখন পরিবর্তনের ম্যান্ডেট থাকবে।

কিন্ত অনির্বাচিত সরকার যদি গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব অবস্টেপিং করে তাহলে সেটা অগনাতান্ত্রিকই হবে।। একটা অভ্যুত্থানের সুযোগে গনতন্ত্র পুনোরুদ্ধারের বদলে আমরা যদি আরেকটা অগনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দীর্ঘ সময়ের জন্য চলে যাই তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে। তখন ইন্টারিম সরকার দেশ চালাতে ভয়াবহ অসহযোগিতার মুখে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আগের সরকার তথা আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সমর্থক ছিলো নানা ক্রাইসিসে ব্যাক আপ দেয়ার। এই রাজনৈতিক শক্তি কিন্ত ইন্টারিম সরকারের থাকবে না। তাই যদি ভবিষ্যতে দেশ চালাতে গিয়ে তাদের কোন ভুলের জন্য তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করে তখন তারা সেটা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা কর‍তে না পেরে প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।।মানে আরেকটা অথরেটেরিয়ান রিজিম হয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

যারা একটা দীর্ঘ মেয়াদি ইন্টারিম বিপ্লবী সরকারের পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের স্বপ্ন সৎ, উদ্দেশ্য সৎ কিন্ত রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেগুলো ইউটোপিয়ান। তাই এইগুলো আত্মঘাতি হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এইসব নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য উপায় হচ্ছে ছাত্ররা নিজেরা রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচন করে জিতে সরকার গঠন করে তারপর বৃহৎ সংষ্কার করা। তখন তাদের লেজিটিমেট ম্যান্ডেট থাকবে সংষ্কার করার।

কিন্ত এই মুহুর্তে একটা নির্বাচনকালীন সরকারের মত, নির্বাচন কেন্দ্রিক সংষ্কার ও দ্রুত নির্বাচন দেয়ার ব্যবস্থা করা ছাড়া সবকিছুতে হাত দিতে যাওয়া ইম্প্রাকটিকাল হবে। তাছাড়া অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলে আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাতে থাকবে। তার উপর মনে রাখবে হবে পরাজিত আওয়ামী লিগের প্রভাব এই সরকারকে প্রছন্নভাবে চ্যালেঞ্জতো জানাবেই- প্রশাসনে, পররাষ্ট্রনীতিতে, নানাভাবেই। সেগুলো মোকাবেলা করে দীর্ঘ সময় ক্ষমতাকে সুসংহত করতে গেলে এই সরকারও অথেরেটেরিয়ান হয়ে পড়ার ঝুকি আছেই।

অতি বিপ্লবী কিংবা অতি রোমান্টিক হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এত রক্ত দিয়ে পাওয়া পরিবর্তন যেন বৃথা না যায়, সেইদিকে নজর দেয়া উচিত।

✍️ বাতেন মাহমুদ
ফেলো, ইয়ুথ পলিসি ফোরাম – ওয়াইপিএফ

Scroll to Top