বেকারত্ব ও অদক্ষতা নিরসনে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবস্থার অবদান কতটুকু?

লিখেছেনঃ আফরিনা আসাদ, 

১০-১৫ বছর পড়াশোনা করেও যখন কারো চাকুরীর বাজারে যেয়ে হিমশিম খেতে হয়, অনেকের আবার নিজেকে শূন্য থেকে গড়ে তুলতে হয় তখন আসলে প্রশ্নটা থেকেই যায় যে আমাদের গলদটা কোথায়? শিখছি, পড়ছি ঠিকই কিন্তু তা কোথায় কাজে লাগাবো কিভাবে লাগাবো সেটা কি শিখছি? শিক্ষনীয় বিষয়গুলোকে বইয়ের পাতা থেকে বাস্তব জগতে প্রয়োগের কৌশল রপ্ত করাটা যেন আমরা শিখতেই পারিনা। নাকি শেখানো হয়না?
২০২১ এর শেষে বেকারত্বের হার ৬% এ পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। করোনার প্রকোপ তো বটেই এর আগেও যে আমাদের ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল তাও জোর দিয়ে বলা যায়না। ২০১৯ এ বিশ্বব্যাপী এক জরিপে আসে দক্ষতার ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থার দিক থেকে বাংলাদেশ মাত্র ৩ টি আফ্রিকান দেশের চেয়ে এগিয়ে। যেখানে একাদশ দ্বাদশ শ্রেনীতে খাতায় লিখে প্রোগ্রামিং শিখতে হয়, ১২ বছর ইংরেজী শিখেও ভর্তি পরীক্ষায় কিংবা চাকুরীতে ইংরেজী নিয়ে হিমশিম খেতে হয় সেই ব্যবস্থা আদৌতে কাজে আসছে কিনা, কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা ভাববার সময় হয়েছে। কিছু বাস্তব সমস্যা ও তার সমাধানের প্রস্তাবনা দেখে নেয়া যাক-

* অভিজ্ঞতার সুযোগ কোথায়ঃ  চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রথমেই চাওয়া হয় অভিজ্ঞতা। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা যদি বরাদ্দ থাকে শেষ বর্ষ আর স্নাতকদের জন্য তাহলে অভিজ্ঞতা অর্জন করে চাকুরীক্ষেত্রে প্রবেশ করবে কি করে? কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা নেয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে আরো অনেক আগে থেকে। এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতন কো-অপ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। যেখানে দুই সেমিস্টার পড়ার পর এক সেমিস্টার একটি কোম্পানীতে পুর্ণকালীন চাকুরী করতে পারে একজন শিক্ষার্থী। এ ব্যাপারে উদ্যোগ আসতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরাসরি কর্মক্ষেত্রের সহযোগিতায়। এছাড়াও স্কুল কলেজের যথাযথ বয়সের শিক্ষার্থীদের মাঝে খণ্ডকালীন চাকুরীর সুযোগ দেয়াটা জরুরী। এতে অনেক আগে থেকেই দক্ষতাভিত্তিক জনবল গড়ে উঠবে। 

* কাঠামো পরিবর্তনের চিন্তাঃ  দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটানা পড়াশোনা করতে হয়, ছোটখাটো ছুটি থাকলেও লম্বা ছুটির অবকাশ নেই। আবার সেশন জটের ঝামেলাও থাকে। উচ্চশিক্ষার কাঠামোগত উন্নয়নে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ। উন্নত দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি ও ছুটির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করা হয়। দুটি সেমিস্টার টানা পড়াশোনা শেষে লম্বা গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। এর আগে এক দুইবার দুই-এক সপ্তাহের ছুটি ছাড়া তেমন কোনো ছুটিই দেয়া হয়না। এই অবকাঠামো অনুসরণ করলে যেমন প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী নিয়োগে একটি সুযোগ ও সময় নির্ধারন করতে পারবে তেমনি শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন পেশাদারী অভিজ্ঞতা পাবে।

* কারিগরি শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিকোনঃ ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে আসে কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ৪% এর কম জনসংখ্যা কারিগরি প্রশিক্ষণ পেয়েছে। কারিগরি বললে যেন আমাদের দৃষ্টিকোণটাই বদলে যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে দেখাই যায়না। শহর গ্রামে, ভাল-খারাপ বৈষম্য না করে বরং সকল স্কুল থেকে এই শিক্ষা দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও কারিগরি শিক্ষা অর্জন ও তার একটি উপায়। এতে সামাজিক দৃষ্টিতে ছোট হওয়ার কোন কারণ নেই। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যে হিড়িক দেখা যায় তা কমবে আর দক্ষ জনবল বৃদ্ধি হবে। 

* ব্যবহারিক ক্লাসের করুণ দশাঃ সৃজনশীলতার কথা বললে প্রথমেই আমাদের ব্যবহারিক ক্লাসের কথা বলা উচিত। পর্যাপ্ত ব্যবহারিক ক্লাস নেই বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে। তাও যা আছে সেখানে আধুনিক সরঞ্জামের ব্যবস্থা বালাই নেই। ব্যবহারিক ক্লাস মানেই সবাই জানে ব্যবহারিক খাতায় নাম, চিত্র সহ শীটের লেখাগুলো হুবহু তুলে দেয়া। শ্রেনীতে যাই শিখিনা কেন তার যদি প্রয়োগের এই হাল হয় তবে বলা বাহুল্য যেকোনো দক্ষতায় পিছিয়ে থাকবে শিক্ষার্থীরা। শারীরিক শিক্ষা বইয়ের পাতার বাস্কেটবল, ভলিবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলাগুলো কিভাবে খেলতে হয় তা এখনো নবম-দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করতে হয়। এমন মুখস্থ ভিত্তিক বিষয় বাদ দিয়ে বরং তাত্ত্বিক বিষয়গুলো সাথে সাথে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ শেখাতে হবে। 

* উদ্যোগের উদ্যোম নেইঃ  যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন শিক্ষার্থীদের দেখেছিলাম ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেনী থেকেই নিজেদের ব্যবসা দাঁড় করে ফেলেছে। এই মানসিকতাটা আমাদের দেশের অনেক চাকুরীজীবীদের মাঝেও দেখা যায়না। শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে চিন্তা শক্তি প্রয়োগ করে উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারে এমন কাঠামো দাঁড় করানো খুব প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে যারা সফল উদ্যোক্তা আছেন তাদেরকে পথিকৃৎ করে তোলা যেতে পারে। বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ক্লাব গঠনে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। এমন সংগঠনগুলো যেন শুধু শহর মফস্বল নয়, গ্রামের দিকেও গড়ে ওঠে এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এবং তা অবশ্যই প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার জোরে আসতে হবে। এর পাশাপাশি যৌক্তিক চিন্তাভাবনা শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এতে যেমন একজন ব্যক্তি ভালো ও সুচিন্তিত নাগরিক হয়ে উঠবে শিক্ষার্থীরা, তেমনি তাদের দক্ষতাও বাড়বে কর্মক্ষেত্রে।

আধুনিক যুগের পড়াশোনা আধুনিক হওয়া চাই। আমাদের সামনে উদাহরণ তৈরি করে রেখে গেছে উন্নত অনেক দেশ। শেখার ও প্রয়োগের আছে অনেক কিছু। তাই দক্ষ জনবল তৈরি শুধু আলাদা প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না রেখে এর পরিধি বাড়াতে হবে বহুদূর। 

আফরিনা আসাদ, 

বাংলা এডিটোরিয়াল অ্যাসোসিয়েট 

ইয়ুথ পলিসি ফোরাম

Leave a Comment

Scroll to Top