মাদক ও মাদকাসক্তির প্রাদুর্ভাব: ঢাকাস্থ খিলগাঁওয়ে অবাধ মাদক‌ পাচার ও সম্পৃক্ত অপরাধের বিস্তার

লিখেছেনঃ সওদাকিন রিশান

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত খিলগাঁও থানা রাজধানীর অন্যতম জনবহুল একটি এলাকা।  রামপুরা, বাড্ডা, বাসাবো, মতিঝিল ও ডেমরা থানার মধ্যবর্তী ও দক্ষিণ বনশ্রীর নিকটবর্তী এলাকা হওয়ার ফলে এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩,৩০,০০০ জনসংখ্যার এক ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয় (আয়তন ১৪ বর্গ কি.মি.,  ঘনত্ব ২৩,৭০০/কি.মি) উল্লেখ্য,আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর ও RAB-3 এর কার্যালয় এই এলাকায় অবস্থিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন প্রতুল উপস্থিতি সত্ত্বেও বিগত কিছু বছরে খিলগাঁওয়ে মাদক পাচার, মাদক ব্যাবসার- মূলতঃইয়াবা”) ভয়ানক উর্ধ্বগতি দেখা গিয়ছে। বলাই বাহুল্য যে, এমন অবাধ সহজলভ্যতার ফলাফল স্বরূপ এখানে মাদক সেবনের তীব্র প্রবণতা তৈরি হয়েছে 

শুধুমাত্র ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত খিলগাঁও এলাকার বিভিন্ন পাচারকারী চক্রের কাছ থেকে সর্বমোট ৫০ হাজারেরও অধিক ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনকি করোনা ভাইরাসের অতিমারীতেও থেমে থাকেনি এখানকার রমরমা মাদক ব্যাবসা। গত এপ্রিল মাসে অত্র এলাকা থেকে চুয়াল্লিশ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে লালবাগ থানার গোয়েন্দা বিভাগ। ইয়াবা পাচারকারী চক্র ও তাদের বাণিজ্য এখানে এতটাই প্রকট যে গত ডিসেম্বর, ২০২০ এ খিলগাঁও থেকে ডাকযোগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পরে এক চক্র। প্রসঙ্গত, বিগত তিন-চার বছরে টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মাধ্যমে ইয়াবা পাচার করার নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করার প্রবণতা দেখা দেয়ায় দেশে সার্বিক ইয়াবা পাচার কয়েক শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন(২০১৮, সং: ২০২০) অনুযায়ী মাদকদ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণ; বহন, পরিবহন বা স্থানান্তর করার শাস্তি স্বরূপ ৫১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হওয়ার নীতি রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বৃহদাকারে  সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চালানো শুরু করে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে ১৪০০০ পাচারকারী, পাচারকারী চক্র ও কয়েক কোটি ইয়াবা জব্দ‌ হলেও এর অবাধ বিস্তারে ভাটা তো পড়েইনি উপরন্তু যেন এই মাদককে কেন্দ্র করে আরো কয়েক শ্রেণীর অপরাধ ও অপরাধচক্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। 

 

কারণসমূহ: 

মাদক সেবন, বাণিজ্য এবং মাদক সংক্রান্ত অপরাধের মুখে সবচেয়ে অরক্ষিত যে তরুণ সমাজ, এ সত্য অনস্বীকার্যমাদকাসক্তি ও মাদককেন্দ্রিক অপরাধের পেছনে সম্ভাব্য মূল কারণ গুলো নিচে তুলে ধরা হল

  • দেশের অভ্যন্তরে কড়া মাদকবিরোধী অভিযান বহাল থাকলেও মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমিনা ও রোহিঙ্গা শিবিরে যথাযথ নজরদারির অপ্রতুলতা কারণ দেশের ৯০ শতাংশেরও অধিক ইয়াবা বর্তমানে‌ প্রবেশ করে এই পথে। টেকনাফ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিরাজমান মাদক পাচারকারী চক্রগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত পরিবারগুলোর কাছে মায়ানমার হতে আসা ইয়াবার চালানগুলো সাময়িক সময়ের জন্য জামানত রেখে পরবর্তীতে সুযোগ‌ বুঝে নিরাপত্তাকর্মীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ করে। একেকটি শরনার্থী পরিবার ইয়াবার চালান জামানত রাখা বাবদ পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত মুনাফা লাভ করে থাকে চক্রগুলোর কাছ থেকে। অর্থনৈতিকভাবে প্রায় নিষ্ক্রিয় এই গোষ্ঠীগুলোর জন্য এটি যথেষ্ট লোভনীয় পন্থা। অন্যদিকে প্রচণ্ড ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ার ফলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মাদকের খোঁজে অভিযান চালোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য একরকম নিষ্ফল প্রচেষ্টা।
  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগগুলো মাদকদ্রব্য পাচার ও সেবনের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকলেও স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনগুলোর তুলনামূলক নজরদারির  অভাব দেখা যায়। যার ফলে খিলগাঁওর মত এলাকাগুলোতে মাদক সরবরাহ ও লেনদেন সহজেই বিস্তার লাভ করে। স্থানীয়দের মতে এখানকার ইয়াবা ব্যবসা ও এর সেবন এতটাই প্রকট যে হরহামেশাই স্থানীয় থানার কয়েকশ গজ দূরত্বের ভেতরেই ইয়াবার লেনদেন চলে।
  •  দেশের তরুন সমাজ ইয়াবার মত মাদকের মূল‌ শিকার এবং এর পেছনে সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক কারণ যেমন পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতা, অনৈতিক পদ্ধতিতে আয়ের প্ররোচনা, সামাজিক বা পারিবারিক বন্ধনের অভাব, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির মত কারণ দায়ী। 
  • ইয়াবার মত মাদক সেবনের প্রবণতা দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত বাংলাদেশে অকল্পনীয়ভাবে বেশী। যেহেতু এই দ্রব্য সেবনের হার বেশি, তাই এর চাহিদাও বেশী। এবং তাই এর ব্যাবসাও বেশ লাভজনক। এজন্য পাচারকারী চক্রগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। 
  • যেহেতু ইয়াবা সরবরাহ ও পাচার একইসাথে ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু লাভজনক, তাই পাচারকারী চক্রগুলো চেষ্টা করে সেবনকারীদের মাধ্যমে এই মাদকের পাচার চালিয়ে যেতে। এভাবে তাদের‌ জন্য‌ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতের নাগালের বাইরে থাকা সহজ‌। অন্যদিকে সেবনকারীরা সহজেই এই ফাঁদে পা দেয় এবং সহজ পন্থায় টাকা আয়‌ করার উদ্দেশ্যে পাচারকারী চক্রগুলোকে সাহায্য করে আর এখান থেকেই শুরু হয় আরও অনেক অপরাধের এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া

নাগরিক পরিবেশে মাদকের কুপ্রভাব

বিগত কয়েক বছরে ঢাকার খিলগাঁও, উত্তরা, মোহাম্মদপুর কিংবা বনশ্রীর মত এলাকাগুলোতে কিশোর গ্যাং-এর যে এক ভয়াবহ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এর মূলে অন্যতম কারণ হিসেবে ‌রয়েছে মাদকের অবাধ বিচরণ। মাদক পাচারকারী চক্রগুলো কিশোর ও‌ তরুন সেবনকারীদের পাচারকাজে ব্যবহার করে সংহত করে। বিভিন্ন‌ চক্রের ছত্রছায়ায় মাদক পাচার ও‌ সরবরাহে সাহায্য করতে গিয়ে কেও কেও নিজের অজান্তেই নিজেকে কোনো গ্যাং এ আবিষ্কার করে আবার কেও হয়তো‌ নিজেই তৈরি করে নিজের গ্যাং। পরবর্তীতে এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে মাদকের চালান কিংবা প্রণয়ঘটিত ব্যাপারেও গ্যাংগুলো একে অপরের ওপর চড়াও হয়। দিনে দুপুরে এক গ্যাংয়ের অনেকে মিলে বিরোধপূর্ণ গ্যাংয়ের কাওকে রাস।তাঘাটে মারধর করা খিলগাঁও এলাকায় বেশ নৈমিত্তিক ব্যাপারএছাড়াও এই কিশোর‌ গ্যাংগুলো‌ প্রায়শই এলাকার ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে সমর্থন লাভ করে এবং উক্ত নেতাদের বরাত দিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালায়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা সাধারণ মানুষের মনে ভয় সৃষ্টির মাধ্যমে এলাকায় প্রতিপত্তি জারি করার স্বার্থে দেশীয় অস্ত্র বহন করে থাকে। বলাই বাহুল্য যে নগরের মোহাম্মদপুর, উত্তরা খিলগাঁও এলাকায় এসব গ্যাং দ্বারা সংঘটিত চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপের খবর নতুন নয়। শুধুমাত্র সাধারণ মানুষই নয়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে জড়িত ব্যক্তিরাও এসব গ্যাংয়ের আক্রোশের শিকার হয় থাকে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে খিলগাঁও এর মেরাদিয়ায় স্থানীয় মাদক পাচারকারী চক্রের ছুড়িকাঘাতে নিহত হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, নিহত যুবক বেশ কিছুদিন ধরেই পুলিশ‌ সোর্স হিসেবে কাজ করে আসছিল এবং তারই রেশ ধরে এই হত্যাকাণ্ড। 

মাদকাসক্তি যে শুধুমাত্র সেবনকারীর আশেপাশের মানুষের জন্যই ক্ষতিকর তা নয় বরং মাদকাসক্তদের জন্যেও বিরুপ পরিণতি বয়ে আনে। বিদেশি বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে কৈশোর মানব জীবনের অন্যান্য পর্যায়ের চেয়ে তুলনামূলক অস্থিতিশীল হওয়ার কারণে এই বয়সেই মাদকাসক্তির প্রভাব প্রকট হয় এবং এই বয়সে মাদকাসক্তির সাথে তৎকালীন এবং পরবর্তী জীবনের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যার প্রবণতা জোরালো সম্পর্ক রয়েছে।  মাধবপুরে কারণে যে আমরা শুধুমাত্র তাজা প্রাণ হারাচ্ছি তাই নয়, বরং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর পরিমাণে সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী হারাচ্ছি প্রতিবছর। এবং যেহেতু আমাদের জনসংখ্যার বিশ শতাংশের বেশি ধারণ করে কিশোর ও তরুণ তাই আমাদের অর্থনীতি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি তারাই। সুতরাং মাদকাসক্তি ও এর ফলে সৃষ্ট হওয়া বিভিন্ন জটিলতা আমাদের সর্বোপরি আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে অন্তরায়

প্রস্তাবনাসমূহ 

  • বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যথাযথ নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করা। দেশের অভ্যন্তরে ইয়াবার প্রবেশদ্বারে যথাযথ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারলে সার্বিকভাবে ইয়াবা পাচার ও সরবরাহের ওপরে লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হতে পারে
  • সরকারি গোয়েন্দা বিভাগ গুলোর পাশাপাশি স্থানীয় থানা পুলিশকেও মাদকদ্রব্য সরবরাহ, পাচার, লেনদেষ, সরবরাহ বিষয়ে কড়া নজরদারি জারি করতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গুলোতে নিয়মিত টহল নিশ্চিত করতে হবে যেন পাচারকারী চক্র গুলো কোন এলাকায়ই ঘাঁটি না গাড়তে পারে।
  •  সংশ্লিষ্ট সরকারি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়  এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে যুব উন্নয়ন বিষয়ক ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে।এসকল সংস্থার মাধ্যমে যুবসমাজকে যথাযথ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংহত করে গড়ে তুলতে হবে, সামাজিক দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার সাথে পযিচিত করতে হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদেরকে মাদকাসক্তি এর উপসর্গ মানসিক স্বাস্থ্য এবং মাদকাসক্তির প্রভাব এর মত সংবেদনশীল বিষয়ে অবহিত করতে হবে।
  • জাতীয় পাঠক্রমের মাদকাসক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য শীর্ষক বিষয়গুলোকে বৃহদাকারে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে  সচেতনতা তৈরির প্রয়াসে। এ ছাড়াও পশ্চিমা পাঠ্যক্রমের অনুকরণে প্রতিটি শিক্ষা পর্যায়ে বাধ্যতামূলক সমাজসেবা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এর ফলে তরুণ সমাজের মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধ, সামাজিক বন্ধন ও সর্বোপরি উৎকৃষ্ট সামাজিক নৈতিকতা তৈরি‌‌ হবে। 
  •   যুব সমাজের অন্যতম বড় সমস্যা বেকারত্বের প্রতি সরকারি দৃষ্টিপাত প্রয়োজনপর্যাপ্ত পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি তার সুষম বন্টন নিশ্চিত করাও প্রয়োজন

 উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে হওয়া সত্ত্বেও সরকারি পর্যায়ে আমাদের কোন তাৎক্ষণিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা নেইজাতীয় পর্যায়ে সরকারি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ২৪/৭ হটলাইন চালু করা যেতে পারেএছাড়াও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সাইকোলজিকাল কাউন্সিলর নিয়োগ দেয়া যেতে পারে যাতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য জনিত জটিলতাগুলো সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিকট তুলে ধরতে হবে।

Leave a Comment

Scroll to Top