লেখায়: ফারিয়া জান্নাত প্রভা
গত ২৯ আগস্ট ওয়াইপিএফ কর্তৃক আয়োজিত আলোচনায় প্রধান বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন প্রফেসর মুশতাক খান যেখানে তিনি ৫ই আগস্ট পরবর্তী নতুন সরকার এর বর্তমান অবস্থা এবং দেশ সংস্কার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। এছাড়াও পূর্ববর্তী সরকারের স্বৈরাচারীতা যেভাবে গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের উন্নতির প্রসারে বাধা হয়েছে তা নিয়েও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেন৷
আলোচনার প্রথমেই তিনি ‘পলিটিকাল সেটেলমেন্ট’ নিয়ে কথা বলেন এবং উল্লেখ করেন সময়ের সাথে কীভাবে বিভিন্ন দলের, সংগঠনের ক্ষমতা ও স্বার্থ- সামর্থ্য বণ্টনের মাধ্যমে আমরা এর ধারণা পেয়ে থাকি।
এই ধারণার সাথে তিনি আরো উল্লেখ করেন কীভাবে ক্ষমতাশালী সংগঠনগুলো তাদের ক্ষমতার প্রভাব চলমান রাখার জন্য শুধু আইনকেই প্রভাবিত করে না বরং আইন কীভাবে প্রয়োগ হবে, কীভাবে আইনের ফাঁক কাজে লাগাবে, অপপ্রয়োগ এবং কোন উপায়ে আইন ভঙ্গ করবে তাও প্রভাবিত করার চেষ্টায় থাকে। এখানে ফুটবল টিমের একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যে ফুটবল টিম খারাপ খেলে সেই দল কখনো চাইবে না যে তাদের দলকে রেগুলেট করার জন্য ভালো রেফারি আসুক কারণ ভালো রেফারি বিভিন্ন নিয়ম কানুনের বেড়াজালে আটকে ফেলবে। এরই সাথে তিনি বলেন, অনেকেই যে মনে করে পলিটিকাল সেটেলমেন্ট মানে রাষ্ট্রের কাজ সম্পাদনে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন যেটির সাথে স্যার একমত নন। বরং তিনি মনে করেন ক্ষমতাসীনদের নিজেদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি বিরোধ থাকে।
কোনো বড় বিপ্লব ছাড়া সব দেশেই সমাজে অথবা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতার বণ্টন বিভাজন স্থায়ী থাকে যা আইনের শাসন, নীতি নির্ধারণ ও দেশের ভবিষ্যত গতিপথকে সুগম করে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত উন্নয়নে দুর্বলতা বাধা দেওয়ার পাশাপাশি আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এখানে প্রায় কার্যকর বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, স্বার্থান্বেষী দলের আগ্রাসন সবচেয়ে বেশী যার ফলস্বরূপ আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়ত দেখতে পাওয়া যায় আইনের দুর্বলতা, বিধিবহির্ভূত কাজ আর দুর্নীতির সাম্রাজ্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ‘রিফর্ম’ তথা ‘সংস্কার’ নিয়ে ধারণা দিয়েছেন যেখানে তিনি বলেছেন, “ক্ষমতা, সামর্থ্য ও দেশ নিয়ে কাজের ইচ্ছার সাথে সমন্বয় রেখে ক্ষেত্র অনুযায়ী বিভিন্ন পলিসির প্রয়োগ”। তবে পলিসির ত্রুটির উপর লক্ষ্য রেখে পলিটিকাল সেটেলমেন্ট এর ক্ষমতা বণ্টন বৈশ্বিক, রাষ্ট্রীয় এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়। গত ২ দশকে বাংলাদেশে আমরা পলিটিকাল সেটেলমেন্ট এর নেতিবাচক দিকটিই দেখে আসছি এবং এটিকে স্যার ‘কম্পিটিটিভ ক্লায়েন্টেলিসম’ বলেই সম্বোধন করেছেন। ২০০৬ সালে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন সংকট মোকাবিলায় যে ২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে সেটি বিভিন্ন রিফোর্ম নিয়ে কাজ করে নি এবং তারই প্রেক্ষাপটে ঊত্থান হয়েছে স্বেচ্ছাচারী আওয়ামী লীগের।
২০০৯-২০১৪ এ এই সরকারের অধীনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার গণ্ডি ছিলো কেন্দ্রীভূত। এই কেন্দ্রীয়করণের বিভিন্ন ধাপগুলোর মধ্যে ছিলো বিরোধী দলের সম্পদ নষ্ট করা বা ছিনিয়ে নিয়ে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অচলাবস্থা করা,উচ্চ মূল্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মেগা করাপশন এবং ব্যাংকের অর্থপাচার।
এছাড়াও ড. মুশতাক এর মতে, গত সরকারের স্বৈরাচারীতা স্থায়িত্বের নেপথ্যে প্রধান ছিলো বিরোধীদল ও তাদের বিরোধীতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। নিজেদের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক দশা ও চায়নার সাথে নতুনভাবে লোন আবেদনে প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর যে নাজুক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা জানা ছিলো বলেই তারা যেকোনো আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় ছিলো। কিন্তু এবার ২০২৪ এর জুলাই ছিলো তার ব্যতিক্রম;বরং প্রতিবাদকারীদের ভয় মুহুর্তেই যেনো ক্রোধে রুপান্তর হয়ে উঠলো যা পরবর্তীতে এই আন্দোলনকে একটি গণআন্দোলনে পরিণত করেছে।
তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে যে গণতন্ত্র দেশে থাকার কথা তা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দমন হয়ে আসা বিএনপি এবং ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভাগদৌড় বাড়তি চ্যালেঞ্জ। সুবিধাবাদী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের রাজনীতিতে মধ্যম পন্থার কোনো দল নির্বাচন কষ্টসাধ্য। দলে জায়গা ও ক্ষমতা পাওয়ার জন্য ক্লায়েন্টিলিস্ট পার্টি যে টাকার লেনদেন করে তার বৈধতা নিয়ে সংশয় আমাদের সবারই আছে।তবে বাস্তবতা হলো এখন যে দলই আসবে, যতদিন পলিটিকাল কম্পিটিশন থাকবে তা অবশ্যই স্বৈরাচার থেকে ভালো হবে আশা করা যায়। মুশতাক স্যার আরো উল্লেখ করেন, আমাদের ২০০৭-২০০৮ থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং সেশন রিফর্মই করতে হবে যা দেশের উন্নয়নে জড়িত প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ক্ষমতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করবে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে মধ্যমেয়াদে সর্বব্যাপী কার্যকর পলিসিসমূহ কার্যকর করতে হবে। অর্থনৈতিক দিকের ক্ষেত্রে আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ নিশ্চিত করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার বৃদ্ধি করতে হবে এবং বছর ধরে ঋণখেলাপ করে অভিজাত্য ধরে রাখার যে অরাজকতা আছে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির সুষ্টু চর্চা নিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনো নতুন স্বৈরাচারের উত্থান বধ করা যায়।
তবে মুশতাক খানের আলোচনার উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে অবিলম্বে কী কী পদক্ষেপ বর্তমান সরকারের নেওয়া উচিত যা দেশের সংস্করনকে আরো তরান্বিত করবে। এই সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থন এসেছে সাধারণ জনগণ থেকে এবং এটি এখনো পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে স্থিতিশীল হয়নি যেটি স্বাভাবিক। তবে অনতিবিলম্বেই সরকারকে দুটি দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে:
১) নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি
২) অর্থনৈতিক অবস্থা
১) নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বলতে গেলেই বিগত সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করা অনেক কর্মীর কথা বলতে হয় যাদের হাতে এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে। কিন্তু তাই বলে সবাইকেই একসাথে জেল দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং প্রমাণের উপর ভিত্তি করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যাতে বাকি যারা আছে তারাও প্রকৃত অর্থে সঠিক বার্তা পায়। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ঢালাওভাবে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া যে মামলা বা আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে তা বরং ভীতি সৃষ্টি করবে।
২) অর্থনৈতিক অবস্থা :
ক) জরুরি ভিত্তিতে ঋণ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম:
শীর্ষ ১০ ঋণ খেলাপকারীর থেকে “অর্থ ঋণ আদালত ২০০৩” এর নিয়ম মেনে তাদের সম্পদ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ব্যাংকে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং এই ঋণখেলাপির সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
খ) উচ্চ মূল্যের ‘বিদ্যুৎ চুক্তিসমূহ’ বাতিল :
উচ্চ মূল্যের এসব চুক্তির ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য প্রতিবছর ভর্তুকি বাবদ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে থাকে। ২৩০০০ মেগাওয়াট এর যে যে বন্দোবস্ত করা হয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই পর্যাপ্ত ইউটিলাইজ করা সম্ভব হচ্ছে না বরং এটির ব্যবস্থাপনা কাজের মাধ্যমে দুর্নীতির সরু রাস্তা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে এসব বড় প্রজেক্টগুলোর টাকা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অতিরিক্ত টাকা ছাপাচ্ছে যা আমাদের মূল্যস্ফীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাই এই সরকারের দরকার এসব প্রজেক্টসমূহ বিশ্লেষণ করে অপ্রয়োজনীয় চুক্তিগুলো বাতিল করা।
গ) পাচারকৃত অর্থকে ফ্রিজ করে দেওয়া এবং পুনরুদ্ধার এর জন্য শক্তিশালী ও কার্যকরী টিম গঠন:
পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার এর জন্য StAR (Stolen Asset Recovery Initiative) মেথড অনুসরণ করে ইউএনওডিসি, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য পার্টনার এর সাথে কাজ করতে হবে।
এছাড়াও ইউকে, কানাডা, ইউএস, সিংগাপুর, সুইজারল্যান্ড এর মত দেশগুলোর আইনি সহায়তা নিয়ে কাজ করতে হবে। তবে আপাতদৃষ্টিতে এই প্রক্রিয়া জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হলেও যদি শীর্ষ অর্থ পাচারকারীর ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করার চেষ্টা করি তাহলে তা বাকি পাচারকারীর জন্যও একটা বিশেষ বার্তা দিবে বলে মনে করেন তিনি।
ঘ) বিগত সরকারের সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করা:
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় অনেকটা বাধা হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বীতার মান। এছাড়াও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপও আমাদের উদ্বেগ এর কারণ। এই ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির সাথে সম্পর্কের দিকগুলো স্বচ্ছতার সাথে নতুনভাবে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে বৈদেশিক চুক্তিগুলো যদি মানুষকে জানানো হয় এবং মতামত নিয়ে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে বৈদেশিক শক্তিগুলোকে নিজেদের চুক্তি আদায়ে কোনো স্বৈরাচারীর পক্ষাবলম্বন করা লাগবে না। তাই সরকারকে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে এই দিকটি বিবেচনায় আনার আহবান জানিয়েছেন তিনি।
ফারিয়া জান্নাত প্রভা ওয়াইপিএফ ইকোনমিক এন্ড ইমপ্লয়মেন্ট পলিসি টিম এর একজন অ্যাসোসিয়েট।