যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই নেতানিয়াহুকে সমর্থন দেয়া বন্ধ করতে হবে: বার্নি স্যান্ডার্স

অনুবাদঃ মাসাফি মুস্তাফা হায়দার

“ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে”

ফিলিস্তিনের গাজা থেকে ছোড়া রকেট হামলার জবাবে ইসরায়েল যখন তাঁর বিশাল সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে পাল্টা আক্রমণে ফিলিস্তিনি জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে , তখন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দুই পক্ষের রাজনীতিবিদদের মুখে কেবল এই কথাই শুনতে পাই।

খোলসা করেই বলি। কেউই বলছে না যে ইসরায়েল বা কোন সরকারেরই আত্মরক্ষা বা এর জনগণকে রক্ষার অধিকার নেই। তাহলে কেন এই একই শব্দগুলো তোতা পাখির বুলির মত বছরের পর বছর একের পর এক যুদ্ধ- সংঘর্ষে  আউড়ানো হচ্ছে?  “ফিলিস্তিনের জনগণের কি অধিকার নেই?” কেন এই প্রশ্নটি কেউ কখনো জিজ্ঞাসা করে না?

কেন শুধুমাত্র  ইসরায়েলের উপর হামলা হলেই আমরা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষের উপর নজর দেই?

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত যত দ্রুত সম্ভব আস্ত্রবিরতির আহ্বান জানানো।  ইসরায়েলের সাধারণ মানুষের উপর রকেট হামলা অগ্রহণযোগ্য হলেও, চলমান সংঘর্ষ যে রকেট হামলার মাধ্যমে শুরু হয়নি তা আমাদের বুঝতে পারা উচিত।  

জেরুজালেমের শেখ জাররাহতে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো বহু বছর ধরেই উচ্ছেদের আশংকা নিয়ে  বসবাস করছে। এমনকি তাদের উচ্ছেদ করতে আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে উগ্রপন্থী ইসরায়েলি জনগণ এই ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করতে তাঁদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন আরও বাড়িয়ে দেয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব উচ্ছেদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়নের ঘৃণ্য ব্যবস্থার একটি অংশ মাত্র। বহু বছর ধরে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের বেআইনি দখলদারি ও গাজার ওপর নিয়মিত অবরোধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার তৎপরতা আমরা শুধু বেড়েই যেতে দেখেছি। গাজায় বসবাসরত বিশ লাখ মানুষের মধ্যে তরুণ জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশই আজ বেকার, তাঁদের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত।  

এদিকে নেতানিয়াহু সরকার ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের কোণঠাসা করার চক্রান্তে নেমেছে। সম্ভাব্য দ্বি-রাষ্ট্রের সমাধানের বিষয়টি ঠেকাতে  ইহুদি বসতি স্থাপন জোরদার করার পাশাপাশি এমন সব আইন পাস করা হচ্ছে, যাতে ইহুদি ও ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য কেবল বাড়তেই থাকে।

তাই বলে এরকম পরিস্থিতিতে হামাসের হামলাকে বৈধতা দেওয়ারও কোন কারণ নেই। হামাসের এই হামলা  জেরুজালেমের অস্থিরতার সুযোগ নেয়া ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (যারা সম্প্রতি তাঁদের বহুল বিলম্বিত সরকার নির্বাচন স্থগিত করেছে) ব্যর্থতারই নামান্তর। আসল কথা হচ্ছে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে ইসরায়েল, যারা শান্তি ও ন্যায়ের পথে না হেঁটে বৈষম্য ও স্বেচ্ছাচারীতার দিকে এগোচ্ছে।

প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ডানপন্থী শাসন কায়েম করে আসা নেতানিয়াহু ইসরায়েলি জনগণের মধ্যে এক ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা ও স্বৈরাচারী বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছেন। ক্ষমতা ধরে রাখতে ও দুর্নীতির অভিযোগে বিচার এড়াতে তিনি ইতামার বেন গভিরের মত ব্যক্তির কট্টরপন্থী ইহুদি রাজনৈতিক দল পাওয়ার পার্টিকে সরকার দলে ভিড়িয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক , যে সকল বর্ণবাদী উশৃঙ্খল জনতা  জেরুজালেমের রাস্তায় ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা করে, তারাই আজ নেসেেটে (ইসরায়েলি সংসদে) বসে ইসরায়েল রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র কায়েম করছে।

এরকম আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি শুধু যে ইসরায়েলে ঘটছে তা কিন্তু  নয়। বিশ্বজুড়ে ইউরোপ, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ সবখানেই আমরা আজ এমন স্বেচ্ছাচারী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান দেখছি। এই অশুভ আন্দোলন ক্ষমতার লোভে জাতিগত বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়ের পথকে দূরে ঠেলে দেয়। গত চার বছর ধরে বিশ্বব্যাপী এসকল আন্দোলনকে মদদ দিতে খোদ হোয়াইট হাউসেই একজন “অকৃত্রিম বন্ধু” (ডোনাল্ড ট্রাম্প) ছিলেন।  

আশার বাণী হচ্ছে, এই  একই সময়ে আমরা এক নতুন প্রজন্মের উত্থান দেখতে পাচ্ছি যারা জনতার দাবি ও রাজনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ গড়তে চায়। গত বছর জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর আমরা এই প্রজন্মকে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে দেখেছি।  আমরা তাদেরকে ইসরায়েলে দেখতে পাই। আমরা তাদেরকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডেও দেখতে পাই।

নতুন প্রেসিডেন্টের আগমনে ক্ষমতার রদবদল হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এখন ন্যায় ও গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার সুযোগ এসেছে।এটি হতে পারে দরিদ্র দেশগুলোকে টিকা পেতে সাহায্য করার মাধ্যমে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে কিংবা  বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মাধ্যমে, যেই মাধ্যমেই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সংঘাত থামিয়ে সহযোগিতার মনোভাবকে উৎসাহিত করতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়া।

যেখানে আমরা মধ্যপ্রাচ্যে প্রতি বছর ইসরায়েলকে ৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়ে থাকি, সেখানে আমাদের কোনভাবেই ডানপন্থী নেতানিয়াহুর বর্ণবাদী ও অগণতান্ত্রিক আচরণকে সমর্থন দেয়া উচিত নয়। আমাদের উচিত এই পথ থেকে সরে এসে এমন ন্যায়সংগত  কৌশল অবলম্বন করা যা বেসামরিক নাগরিকদের মূল্যবান জীবন রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইনকে শক্তিশালী ও সমুন্নত করে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহৃত না হয় তা আইনসঙ্গত উপায়ে নিশ্চিত করতে হবে।

এটা মানতে হবে যে, ইসরায়েলের যেমন শান্তিতে ও নিরাপদে থাকার অধিকার রয়েছে, তেমনি ফিলিস্তিনেরও একই অধিকার রয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ গড়তে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি সারা বিশ্বের কাছে মানবাধিকার রক্ষার মূর্ত প্রতীক হতে চায়, তবে শত রাজনৈতিক জটিলতা সত্বেও  আমাদের উচিত মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে ধারাবাহিক ভূমিকা পালন করা। ফিলিস্তিনিদের যে অধিকার আছে তা আমাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। কেননা ফিলিস্তিনিদের জীবনও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

দ্য  নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তরঃ   মাসাফি মুস্তাফা হায়দার, ইন্টার্ন ওয়াইপিএফ কন্টেন্ট এন্ড এডিটোরিয়াল (বাংলা)             

মূল লেখার লিংকঃ
https://www.nytimes.com/2021/05/14/opinion/bernie-sanders-israel-palestine-gaza.html

Scroll to Top