পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় পিতৃত্বের ভূমিকা বা বাবাদের করণীয়

লিখেছেনঃমাইশা মালিহা  

কোথাও একটা পড়েছিলাম “আমাকে একজন নারীবাদী বাবা দাও তাহলে আমি একটি সমতার জাতি উপহার দিবো”, কথাটা দারুণ লেগেছিল। 

যেহেতু আমরা একটি সুপ্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করি তাই আমি বিশ্বাস করি পুরুষতন্ত্রের বেড়াজালকর্তৃক যেসব অসমতার জড় রয়েছে সেগুলোকে নিঃশেষ করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন আমাদের বাবারা, কেননা অর্থনৈতিক দিক থেকে শুরু করে পরিবারের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের গুরুভার সাধারণত তাদের ওপরেই ন্যস্ত থাকে। সন্তানরাও পরিবার থেকেই তাদের প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে থাকে। তাই অভিভাবক হিসেবে বাবারা যখন সমঅধিকারে বিশ্বাসী হবেন এবং পরিবারে সেটির চর্চা করবেন, সন্তানদের একই শিক্ষায় দীক্ষিত করবেন তখনই সেটির একটি বিশাল প্রভাব পড়বে সন্তানদের চিন্তাভাবনা ও মানসিকতায়। যার ফলস্বরূপ সন্তানরা ছোট থেকেই সমঅধিকারের আদর্শ লালন করে বেড়ে উঠবে।

পুরুষতান্ত্রিকতার ভয়াল আগ্রাসনের শিকার যে শুধু মেয়েরা তা নয়, বরং ছেলেরাও এর ভুক্তভোগী। লৈঙ্গিক পরিচয়ের ভিত্তিতে যেকোনো মানুষের উপর জেন্ডার রোলস বা প্রচলিত জেন্ডার নর্মস চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারগুলোতে এর প্রতিফলন দেখা যায়। যেকোনো কাজ, পোশাক থেকে শুরু করে এমনকি আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রেও ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য নিয়ে আসা আমাদের সমাজে একটা সাধারণ বিষয়। যেমন: ছেলে সন্তানদের শৈশব থেকে বাড়ির যাবতীয় কাজ করতে বা শিখতে না দেওয়া, সেগুলোকে ‘মেয়েদের কাজ’ বলে অভিহিত করা বা শুধু মেয়ে সন্তানদেরকে দিয়েই সেসব করানো বা শিখানো, পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রে এমনকি যেকোনো বস্তুর রঙ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও কোনোটিকে মেয়েলি বা কোনোটিকে পুরুষালি বলে অভিহিত করা, আবার ছেলেদেরকে ছোটথেকে ওতটা প্রকটভাবে তাদের আবেগ প্রকাশ করতে না দেওয়া, তাদের আচরণে সর্বদা কঠোরতাকে প্রশ্র‍য় দেওয়া বা তাদের কাঁদতে বারণ করা কারণ ছেলে বলে বা ‘ছেলেদের কাঁদতে হয়না বলে’ এবং মেয়েদেরকে সর্বদা নমনীয় হতে বলা এবং মেয়ে বলে তাদের এধরনের যাবতীয় সকল বৈষম্যমূলক আচরণকে মেনে নিতে বলা; এসকল স্টেরিওটাইপস মূলত শুরু হয় পরিবার থেকেই যা সন্তানদের পরবর্তী জীবনে গিয়ে ফেলে ভয়াবহ বিস্তর প্রভাব। বিশেষত যে সন্তানরা নন-বাইনারী, তাদের জন্য এসকল স্টেরিওটাইপস নিয়ে আসে নানা প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু পরিবারের বাবারা যদি এসকল স্টেরিওটাইপসকে প্রশ্রয় না দেন বরং ছোটবেলা থেকেই যদি সন্তানদের এই শিক্ষায় শিক্ষিত করেন যে, কোনো কাজ, পোশাক, আবেগ এবং  এ যাবতীয় সকল কিছুর কোনো জেন্ডার হয় না বরং সন্তানরা তাদের স্বাচ্ছন্দ্যমত যেকোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারবে তাহলে সেখান থেকেই আমরা একটু একটু করে ভাঙতে পারবো সমাজের তথাপ্রচলিত জেন্ডার নর্মস।

আবার অনেক পুরুষই রয়েছেন যারা মুখে সমঅধিকারের কথা বলে ঠিকই কিন্তু নিজের পরিবারে নারী সদস্যদের ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রতিফলন ঘটায় না। নিজের স্ত্রীর চাকরি করাতে বিঘ্ন ঘটায়, বাড়ির কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করে না বা স্ত্রীর স্বাধীনতা ও অধিকার ঠিকই ক্ষুণ্ন করে, যার প্রাথমিকভাবে একটি বাজে প্রভাব পড়ে সন্তানদের উপর কিন্তু ঠিক উল্টোটা যখন হবে অর্থাৎ সন্তানরা যখন এটি দেখে বেড়ে উঠবে যে তাদের বাবা তাদের মাকে অন্য সকল স্বাধীন মানুষের মত তার সকলকিছুকে সম্মান করে, মর্যাদা দেয়, কোনো কাজ জেন্ডার রোলসের ভিত্তিতে করে না বরং দুইজনই সকলকাজে সমানভাবে অংশগ্রহণ করে, কেউ কারও অধিকার ক্ষুণ্ন করে না বরং সর্বদা সমতার চর্চা করে তখন সন্তানরাও কিন্তু নিজেদের মধ্যে সেই একই আদর্শকে লালন করে বেড়ে উঠবে। সঙ্গে সন্তানদের ক্ষেত্রে এটি একটি উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। ছেলে সন্তানরা যেমন ছোট থেকে এটি শিখবে কোনো নারী তার ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, সে কোনো নারীর কোনো অধিকার ক্ষুণ্ন করার কোনো অধিকার রাখে না, সেই নারী তার যেই হোক না কেনো; তেমনি মেয়ে সন্তানরাও এই আদর্শ নিয়েই বড় হবে যে সে সর্বপ্রথম একজন স্বাধীন ‘মানুষ’, তার স্বাধীনতা বা তার কোনো অধিকারই ক্ষুণ্ন করার বা তাকে কোনো দিক থেকে শোষণ করার কোনো অধিকার রাখে না কোনো মানুষ, কোনো পুরুষ; হোক সে তার নিজের জীবনসঙ্গী বা অন্য কেউ। নারীবাদী বাবার নারীবাদী আদর্শ যেমন নিজের পরিবারে নারীভিত্তিক অসমতা, বৈষম্য ও শোষণকে দূরে রাখবে তেমনি সন্তানদের ক্ষেত্রে বিশেষত মেয়ে সন্তানদের ক্ষেত্রে সেই একই আদর্শ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার বৈষম্যকেন্দ্রিক লড়াইয়ের ময়দানে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, প্রেরণা এবং উৎসাহ হিসেবে।

‘মুক্তি নয় রক্ষা চাই’- আমার সবচেয়ে প্রিয় স্লোগানগুলোর একটি। আমি অনেক বাবাকে দেখেছি তারা তাদের মেয়ে সন্তানদের নিয়ে অতিরিক্ত রক্ষণশীল, আমি বুঝি তারা নিজেরা যেহেতু পুরুষতন্ত্রের ভয়াল আগ্রাসন সম্পর্কে ভালোমত অবগত তাই তাদের নিজেদের মেয়েরা যাতে সেইসব আগ্রাসনের স্বীকার না হয় সেজন্য তারা এমন রক্ষণশীল কিন্তু এই অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা যে তাদের মেয়েকে পরনির্ভরশীল করে তোলে এটি বেশিরভাগ সময়ই তারা ভুলে যায়। যা পরবর্তীতে ওই মেয়ের জন্যই বাধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থাৎ ওই পরনির্ভরশীলতার জায়গাটি। কারণ যখন কোনো মানুষ অন্য একটি মানুষের উপর নির্ভরশীল হয় বা কোনো একটি কারণে সে অন্য কোনো ব্যক্তির অধিনস্থ থাকে কেবল তখনই সেই মানুষের উপর অন্য মানুষটির পাওয়ার এবিউজের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়, যেই সুযোগটা সাধারণত নারীদের ক্ষেত্রে নিতে চায় পুরুষতন্ত্র। এদিক দিয়ে নিজের বাবার প্রতি আমি প্রচণ্ডভাবে কৃতজ্ঞ কারণ বাবা আমাকে ছোট থেকে একটা কথা খুব ভালোমত বুঝিয়েছেন যে যাই হোক আমাকে জীবনে অবশ্যই স্বনির্ভরশীল হতেই হবে কারণ তিনি সারাজীবন অভিভাবক হিসেবে আমাকে রক্ষা করার জন্য থাকবেন না এবং এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তিনি চান না এই রক্ষাকর্তার স্থান আমি নিজে ব্যতিত অন্য কোনো মানুষকে, অন্য কোনা পুরুষকে দেই কারণ তিনি জানেন এই নির্ভরশীলতার স্থান আমি যখনই অন্য কাউকে (বিশেষত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনো পুরুষকে) দিবো তখনই সেই নির্ভরশীলতার সুযোগকে ব্যবহার করে অন্য কারোর আমাকে শোষণ করার একটা সম্ভাব্য সুযোগও আমি তৈরি করে দিবো। হ্যাঁ আমি এটা মানি, সন্তানদেরকে একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত অভিভাবকদের রক্ষা করার প্রয়োজন হয় কিন্তু সেই রক্ষণশীলতা যেন কোনো সন্তানের বিশেষত মেয়ে সন্তানের নির্ভরশীলতায় পরিণত না হয় সেদিকে অভিভাবকদের খেয়াল রাখাটাও বিশেষ জরুরি।

আবার সন্তানদের সাথে বাবাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়াটাও আমি মনে করি অভিভাবক ও সন্তানদের মধ্যে একটি অত্যাবশ্যক বিষয় হওয়া উচিত। বেশিরভাগ সময় অভিভাবকরা বিশেষত বাবারা কঠোর হতে গিয়ে সন্তানের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তৈরিতে ব্যর্থ হন। এতে যেমন সন্তানদের সাথে বাবাদের একটি মানসিক দূরত্ব তৈরি হয় তেমনি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেও পড়ে একটি বিস্তর প্রভাব। আবার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন ট্যাবু টপিকগুলো, যেগুলো সন্তানদের জন্য জানা খুবই প্রয়োজনীয় যেমন: সেক্স এডুকেশন কিংবা পিরিয়ড সম্পর্কিত বিষয়গুলো, এসব নিয়ে বাচ্চাদের সাথে অভিভাবকদের বিশেষ করে বাবাদের (কারণ এই সম্পর্কিত বিষয়সমূহ দেখার দায়িত্ব শুধু মায়েদের একার না) আলোচনা করা উচিত। কারণ পরিবারের ওপরই তো এসকল বিষয়াবলি শিক্ষাদানের প্রাথমিক দায়িত্ব বর্তায়, তাই পরিবার থেকেই যদি এসকল কিছুকে ট্যাবু হিসেবে ধরা হয় তাহলে বাচ্চারা এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অবগত হবে কোথা থেকে? 

আজ বাবা দিবস, প্রতিবছর বাবা দিবসে বাবাদের সারাবছর অক্লান্ত পরিশ্রম নিয়ে আমরা অনেক লিখি, তারা পরিবারের জন্য যে পরিমাণে পরিশ্রম করেন সেটি নিঃসন্দেহে অতুলনীয় কিন্তু (এই একপাক্ষিক অক্লান্ত পরিশ্রমের ভারও কিন্তু আসে মূলত পুরুষতান্ত্রিকতা থেকেই) উপরে বর্ণিত পরিবারের এই সকল বৈষম্যগুলোকে নিঃশেষ করতে বাবারা যেসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন সেগুলো নিয়ে আমরা কখনোই ততটা বলিনা এবং যতদিন পর্যন্ত না আমরা উপরোক্ত এই বিষয়সমূহ নিয়ে ততটা সোচ্চার হবো, ততদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র একপাক্ষিক শ্রম দিয়ে আমরা কখনোই একটি সম্পূর্ণ সমঅধিকারসম্পন্ন জাতি তৈরিতে সক্ষম হবো না। তাই বাবাদের কাছে উপরোক্ত এই সকল বিষয়ের পরিবর্তনের আশা রেখে সকল বাবাদের জানাচ্ছি বাবা দিবসের নিরন্তর শুভেচ্ছা…

 

The author is a current student of Viqarunnisa Noon College, Dhaka. She’s an artist, who’s aspiring to become a gender rights activist and wants to bring social changes through her intractable colors and words. She’s currently working at TransEnd. 

She can be reached at maishamalihaislam@gmail.com

Leave a Comment

Scroll to Top