বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলোর মালিকপক্ষ কর্তৃক অবহেলাজনিত দূর্ঘটনাসমূহে ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকগণ ও তাদের ভুক্তভোগী পরিবাররা এইপর্যন্ত কতটুকু সঠিকভাবে ন্যায়বিচার পেয়েছেন?

লিখেছেনঃ মাইশা মালিহা

২০১২ এর আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ড থেকে শুরু করে ২০১৫ তে কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডসহ গত ছয় বছরে ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী দেখা যায় যে সারা দেশে শিল্পকারখানায় মোট অগ্নিকান্ডের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৮১টি। যেসব অগ্নিকাণ্ডের ভুক্তভোগীদের  মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন কারখানার শ্রমিকগণ। এছাড়াও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের হিসাবমতে, ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানার দুর্ঘটনায় প্রায় ৫০০ শ্রমিক মারা গিয়েছেন এবং তথ্যানুযায়ী দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব অঘটনের সূত্রপাত ঘটেছিল মালিকপক্ষের অবহেলা এবং অসচেতনতা থেকে। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ এসব ঘটনার বেশিরভাগকেই হত্যাকাণ্ড এবং ফৌজদারি অপরাধ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এসব ঘটনাসমূহ যাচাই করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ শিল্প কারখানার মালিকগণই শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন একটা ভাবে না। এর সঙ্গে কারখানা বিল্ডিংগুলোর অনুমোদিত নকশা উপেক্ষা করে অনুমোদিত তলার পরিবর্তে বেশি তলা নির্মাণ থেকে শুরু করে নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহার, কারখানাগুলোতে জেনারেটর ও বয়লারসহ বিপুল পরিমাণে যন্ত্রপাতি স্থাপন, সিঁড়ির সংখ্যা ঠিক না রাখা বা সিঁড়িগুলোকে অত্যন্ত সরু করে বানানো, জরুরি নিগর্মন ব্যবস্থা বা ইমারজেন্সি এক্সিট না রাখা, বিল্ডিংগুলোর ফায়ার সেফটি কোড না মেনে চলা এগুলো তো আছেই। এরই পাশাপাশি আবার শ্রমিক আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও মূল ফটকে তালা দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করানো, শিশু শ্রমিক নিয়োগ -এ সকলকিছু আইনগতভাবে অপরাধ হওয়ার সত্ত্বেও গত দশকের শিল্প কারখানাসম্বলিত বেশিরভাগ দুর্ঘটনাগুলোতেই এগুলোর  উদাহরণ পাওয়া যায়। 

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জের সজীব গ্রুপের কারখানার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আবারো  এর প্রমাণ পাওয়া যায়।  রূপগঞ্জের এই  অগ্নিকাণ্ডে প্রায় পঞ্চাশোর্ধ শ্রমিক নিহত হয়েছেন যার মধ্যে একভাগ ছিল ১১-১৭ বয়সী শিশু এছাড়াও এখনো নিঁখোজ রয়েছেন অনেক শ্রমিক। 

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আগুনের সুত্রপাত হয় মূলত কারখানায় এক তলায় রাখা দাহ্য পদার্থগুলো থেকে কিন্তু শ্রমিকদের ভাষ্যমতে এর আগেও একাধিকবার এমন ছোট ছোট আগুন লাগার কারণে এইবারের আগুনকেও তেমন গুরুত্ব না দিয়ে কারখানার মূল ফটকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাদের উত্তেজিত হতে নিষেধ করা হয়, যাতে আগুন লাগার অজুহাত দিয়ে কোনো শ্রমিক “কাজ ফাঁকি” না দেন। 

সঙ্গে আরও জানা যায়, এত বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণকারী বিল্ডিং এ কোনো ফায়ার সেফটি কোড ছিল না, তার উপর দিয়ে সিঁড়ির সংখ্যাও ছিল কম এবং যে দুটো সিঁড়ি ছিল তা ছিল অত্যন্ত সরু যার ফলে শ্রমিকদের এমন জীবন্ত বলির শিকার হতে হয়। যদিও গতকালকে হাসেম ফুডসের প্রধান আবুল হাসেম ও তার ছেলেদেরকেসহ আটজনকে এই মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় কিন্তু এতে অগ্নিকাণ্ডে হতাহত ভুক্তভোগীরা আদেও কতখানি ন্যায়ের আশ্র‍য় পাবেন? বা শ্রমিকগণদের এসব অপূরণীয় ক্ষতির কতখানিই বা লাঘব হবে? 

পূর্বের এরুপ বহুল আলোচিত ও ট্র্যাজিক ঘটনাগুলো যাচাই করলে দেখা যায়, ২০১২ তে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আট বছর হওয়ার পরেও গত বছর প্রেসক্লাবের সামনে জড় হতে হয় ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের, তাদের ক্ষতিপূরণের চাওয়ার দাবিতে। সেখানে আসা শ্রমিকগণ জানান,  আটবছর হয়ে যাওয়ার পরেও  এখনো তারা ঠিকমত কোনো ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং সুচিকিৎসা পাননি।

প্রেসক্লাবের সামনে  অবস্থানরত শ্রমিকগণদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সেখানে যারা এসেছিলেন সবাই গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার জন্য তারা চাইলেও কাজে যোগ দিয়ে নতুন কর্মজীবন শুরু করতে পারেননি। যদি তারা এই আট বছরে সঠিক ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা পেতেন তাহলেও অন্তত তাদের এভাবে অভুক্ত থাকতে হতো না। অন্যদিকে অভিযুক্ত তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসের অধিকর্তার বিচারেরও কোনো অগ্রগতি হয়নি, বরং তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ডের মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন সহ মোট ১৩ জন আসামি সকলেই এখন রয়েছে জামিনে।

আবার ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধ্বসের মত অন্যতম নৃশংস মৃত্যুর ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচারও এখনো তেমন একটা এগোয়নি, স্থগিতাদেশে সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়াও আদালত সূত্রানুযায়ী, রানা প্লাজা ধ্বংস হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা বাদে বাকি আর ৪০ জন আসামির ৩২ জনই এখন রয়েছে জামিনে, দুইজন মারা গিয়েছে আর বাকি ছয়জন এখনো পলাতক।  

এছাড়াও এসব হত্যাযজ্ঞে ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকগণদের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ হতে জানা যায়, দুর্ঘটনার জন্য শ্রম আইনে যে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে সেটাও শ্রমিকগণ বা তার পরিবাররা ঠিকমত পান না আর অবহেলাজনিত হত্যা প্রমাণ না হলে ক্ষতিপূরণ আরও পাওয়া যায় না। এখনো পর্যন্ত এই আইনে কোনো মালিকপক্ষ বা দায়ীরা শাস্তি পেয়েছেন এমন নজির নেই।

পূর্বের এসব ভয়াবহ বহুল আলোচিত অবহেলাজনিত হত্যাকান্ডে প্রাণ হারানো ও আঘাতপ্রাপ্ত শ্রমিকগণ ও তাদের ভুক্তভোগী পরিবাররা এখনো যেখানে ন্যায়বিচার, পুনর্বাসন, সুচিকিৎসা কিছুই ঠিকমত পাননি, সেখানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমরা আসলেই কতখানি ন্যায়বিচার বা ক্ষতিগ্রস্থদের এমন ভয়াবহ ক্ষতিসমূহ লাঘবের আশা রাখতে

 

-মাইশা মালিহা, ওয়াইপিএফ বাংলা এডিটোরিয়াল এসোসিয়েট 

The author is a current student of Viqarunnisa Noon College, Dhaka. She’s an artist, who’s aspiring to become a gender rights activist and wants to bring social changes through her intractable colors and words. She’s currently working at TransEnd, an organisation which works for the welfare of the marginalized gender diverse communities in Bangladesh with a hope to abolish the roots of gender-based violence. 

She can be reached at maishamalihaislam@gmail.com

Leave a Comment

Scroll to Top