গ্যাং কালচার ! চট্টগ্রামের সামাজিক অবস্থার অধঃপতন?

লিখেছেনঃ শেখ সাব্বির ইসলাম মাহি, হামজারবাগ, চট্টগ্রাম থেকে

দেশের অন্যান্য জায়গার মতো বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলেছে কিশোর অপরাধ। শহরের প্রায় প্রত্যেকটি এলাকায় শিশু কিশোররা তাদের নিজস্ব একটি দল তৈরি করে চুরি , ডাকাতি, ছিনতাই,চাঁদাবাজি, এমনকি হত্যা ,ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি গত সাতাইশে এপ্রিল নগরীর পাঁচলাইশ থানার অধীন মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাং এর ছুরিকাঘাতে চৌদ্দ বছরের এক কিশোর মৃত্যুবরণ করে। এছাড়াও গত মার্চ মাসে আগ্রাবাদ এলাকায় ও কিশোরদের মধ্যে একই ধরণের ছুরিকাঘাতে আরেকজনের মৃত্যু ঘটে । অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

আমার বসবাসরত এলাকা হামজারবাগে অহরহ উঠতি বয়সের শিশু কিশোররা তাদের গ্যাং তৈরি করছে। ২০২০ সালে ইদের দিনেও এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে কথা কাটাকাটির জের ধরে হত্যা করে ফেলে। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, নগরীর সামাজিক নীতি নৈতিকতা কতটা নিম্নস্তরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ! করোনা মহামারিতে কিশোর অপরাধ আরো বৃদ্ধি হচ্ছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে , মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা এইধরণের গ্রুপগুলোর সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে অভিভাবকের দায়ত্বহীনতার সাথে সাথে , ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি এবং এই বয়সে কোন ভালো সঙ্গ না পাওয়াকে দায়ী করা যায়। কেননা উঠতি বয়সে শিশু কিশোরদের মনে একধরণের উচ্চাভিলাষি চিন্তা ধারণার জন্ম দেয় । এই চিন্তা ধারণা জন্ম নেওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই বিদেশি সিনেমা বা নাটক গুলোতে যেসব কর্মকান্ড দেখানো হয় তাকে দায়ী করে। এতে করে শিশু কিশোররা সিনেমার নায়ক বা ভিলেনদের মতো সমাজে দাপট দেখাতে আগ্রহী হয়। আর এই আগ্রহে পূরণে অনেকেই এলাকার বড় ভাইদের নিকটস্ত হয়। 

অর্থাৎ শিশু কিশোরদের এই গ্যাং গালচারের প্রতি জড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিম্নোক্ত কারণগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে –

  • অভিভাবকের দায়িত্বহীনতা
  • ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি আসক্তি
  • উচ্চা্ভিলাষি আকাঙ্খা
  • এলাকার বড় ভাই নামক এক শ্রেণির উত্থান

সমগ্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এই গ্যাং কালচারের প্রভাব খুবই মারাত্নক। বিশেষ করে ঢাকা শহরে অহরহ শিশু কিশোররা চাঁদাবাজি, ছিনতাই এর মতো কার্যক্রম করে চলছে। টিকটক, লাইকি অ্যাপ এর মতো মাধ্যমে খ্যাতি লাভের জন্য শিশু কিশোররা আজ অশ্লীল, বেআইনি কাজ করেই চলেছে। 

এছাড়া প্রথম আলোর এক সুত্রে জানা যায় রাজশাহীতে কিশোর গ্যাং এর সাথে জড়িয়ে পড়ছে তরুণীরাও। তারা প্রতারণার ফাঁদ পেতে মানুষকে হয়রানি করে চাঁদাবাজি করছে আর এই চাঁদা দিয়ে তারা মাদক সেবন সহ আরো নানা খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ দেশে যদি সামাজিক অনুশাসন গড়ে না উঠে তাহলে আমাদের জন্য খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে বলে ধারণা করা যেতেই পারে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১২ সালে কিশোর অপরাধের ঘটনায় সারাদেশে মামলা রেকর্ড হয়েছে ৪৮৪টি। মামলায় আসামির সংখ্যা ৭৫১ জন। ২০১৩ সালে কিশোর অপরাধের ৫৮৯ মামলায় আসামি ৮৪৮ জন। ২০১৪ সালে মামলা হয়েছে ৮১৮টি, আসামির সংখ্যা এক হাজার ২৬৩। ২০১৫ সালে এক হাজার ১৮৪টি। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ৫৯৬টি। এ হিসাবে এক বছরে কিশোর অপরাধের মামলা বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশের বেশি। 

কিশোর অপরাধ রোধে তেমন কঠোর কোন পদক্ষেপ বা পলিসি এখনো দেখা যায় নি। যদিও চট্টগ্রামসহ দেশের নানা অঞ্চলে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে কিশোরদের এই ধরণের অপরাধ নির্মুলে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও  বিভিন্ন আপরাধে অভিযুক্ত শিশু কিশোরদের শিশু –কিশোর সংশোধনকেন্দ্রেও পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাই বলা যায় খুব অল্প পরিসরে কিশোর অপরাধ রুখতে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কিন্ত কেন এই ধরণের ক্ষুদ্র পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে যে শিশু আইন -২০১৩ দিকে আমাদের লক্ষ্য করতে হবে। উক্ত আইনে দেখা যায় শিশুদের (শিশু বলতে ১৮ বছর পর্যন্ত বুঝানো হয়েছে) মারাত্নক অপরাধের জন্য তেমন কোন শাস্তি দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা না হলেও যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে তা অত্যন্ত সাধারণ। সেখানে বলা হয়েছে মারাত্নক অপরাধের জন্য আলাদা কারাদন্ড বা প্রত্যায়িত প্রতিষ্ঠানে শিশুদের আটকে রাখা । এক্ষেত্রে এদেরকে বেশিরভাগ সময় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। আমরা যদি দেশের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামোগত অবস্থার দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে এদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো নামে মাত্রই উন্নয়ন কেন্দ্র হয়ে আছে। এসব উন্নয়ন কেন্দ্র গুলোতে শিশুদের আরো ক্ষতি হওয়া সম্ভাবনাই বেশি । ফলস্বরুপ অনেকেই এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।

এছাড়াও শিশু কিশোরদের কোন গবেষণা, মূল্যায়ন, পর্যবেক্ষণের কথা বলা হলেও বাস্তবে তার উদাহরণ খুবই কম।

এই গ্যাং কালচার রোধে আমাদের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত দিতে হবে বলে আমি মনে করি

প্রথমে শিশুদের মানুষিক অবস্থার দিকটি বিবেচনা করতে হবে। তাদের  মানুষিক অবস্থার উন্নয়ন ব্যতীত আমরা কিছুই করতে পারব না।  

করোনা মহামারিতে যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ সেহেতু তারা যেন বিপথগামী না হয় তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর মান বাড়াতে হবে

এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তাদের ছত্রছায়ায় শিশু কিশোররা যেন নষ্ট না হয়। এজন্য প্রয়োজনে ১৮ বছরের নিচে কোন শিশু- কিশোররা যেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ্ না করে সে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

অভিভাবকদের দায়িত্বশীলতার সাথে সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণও করতে হবে।

উক্ত পদক্ষেপ গুলো তখনই বাস্তবায়ন করা যাবে যখন সমাজে একটি অনূকুল অবস্থা সৃষ্টি করা যাবে। আমার এলাকায় শিশু কিশোরদের জন্য খেলাধূলার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। একটি খেলার 

মাঠ যেটি আছে সেটিও এখন বন্ধ হওয়ার পথে। কিন্ত এইসব শিশু- কিশোরদের যদি আমরা সুবাতাস না ই দিতে পারি তাহলে আমরা এই সমস্যা সমাধান করতে পারব কিনা তার সন্দেহ থেকেই যায়। কেননা একজনের মানুষিক ও শারীরিক উন্নয়নের জন্য প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক থাকা একান্ত প্রয়োজন। তাই আমি মনে করি এই ধরণের গ্যাং কালচার রোধে শুধুমাত্র সেই শিশু কিশোরদের অভিভাবক বা সরকারকে এগিয়ে আসলেই হবে না, প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াসের ! চলুন না ,এই  সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচাই !

Scroll to Top