বই রিভিউঃ এন এনিমি অব দ্য পিপল – হেনরিক ইবসেন (সুবাহ বিনতে আহসান)

পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু সেই পানিই যখন মারণরোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়? ছোটবেলায় নীতিকথার গল্পগুলোয় আমরা জেনে এসেছি সত্যের জোরের কথা, কিন্তু সামষ্টিক মিথ্যের জোর? জর্জ কার্লিন বলেছিলেন “Never underestimate the power of stupid people in large groups.” তিনিই কি ঠিক ছিলেন? পানি, বাঁচা-মরা, সত্য-মিথ্যা, ক্ষমতা আর এক ব্যক্তির সংগ্রাম- এই সবেরই অমর উপাখ্যান “এন এনিমি অব দ্য পিপল”।

এই নাটকের মূল চরিত্র থমাস স্টকম্যান একজন ডাক্তার ও বিজ্ঞানী। বেঁচে থাকার জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হলেও সেই সংগ্রামের একটুও আঁচ লাগেনি ডা. স্টকম্যানের স্বাপ্নিক ও আদর্শবাদী সত্তায়। জীবনের অনেক চড়াই-উতড়াই পেড়িয়েও ডা. স্টকম্যান স্বপ্ন দেখতে পারেন, নতুনভাবে নতুন দিনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অসীম প্রাণশক্তি তার আছে। এই ডা. স্টকম্যানের বসবাস যে শহরে, সেই শহরটির বাড়বাড়ন্তের মূলে রয়েছে কির্স্টেন ঝর্ণা। এই ঝর্ণার কারণেই শহরটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়েছে, এমনকি অসুস্থ রোগীদের হাওয়াবদলের জন্যেও এখানে আসার পরামর্শ দেন অনেকে। কিন্তু কেবলই অনুসন্ধিৎসা থেকে ডা. স্টকম্যান আবিষ্কার করেন এক ভয়ানক সত্য। শহরের লক্ষ্মী বলে যে কির্স্টেন ঝর্ণা পরিগণিত, তার মধ্যেই কিছু মরণব্যাধির জীবাণুর বসবাস!

 

নতুন আবিষ্কারের উত্তেজনা যেমন ঘিরে ধরে ডা. স্টকম্যানকে, তেমনি শহরের অধিবাসী ও পর্যটকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে প্রমাদ গোণেন তিনি। আদর্শবান ও দায়িত্বশীল একজন নাগরিক হিসেবে তিনি সকলকে জানাতে চান এই মহাসত্যটি, এমন সময় তার পাশে এসে দাঁড়ায় তার সমাজসচেতন মেয়ে পেত্রা। তাকে আরও সমর্থন জানান স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক হোভস্টাড, সেখানকার এক কর্মী বিলিং ও শহরের মালিক সমিতির প্রতিনিধি এসলাকসেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে পাশে পেয়ে গেছেন এই ভরসায় পরম উৎসাহে এগোতে থাকে ডা. স্টকম্যান। তিনি ভেবেছিলেন শহরের সকলের ভালোর স্বার্থে পাশে পাবেন তার ভাই শহরের নগরপিতা পিটার স্টকম্যানকে। কিন্তু পিটার স্টকম্যান তো আর তার ভাইয়ের মত সকলের ভালোতে বিশ্বাসী নয়, সে বিশ্বাস করে ক্ষমতায়, অর্থে। আর কিরস্টেন ঝর্ণাকে নিয়ে এমন খবর চাউর হলে যে তার ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে এটা সে ভালোই জানে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে সত্য প্রচার থেকে ডা. স্টকম্যানকে নিবৃত্ত করার, কিন্তু ডা. স্টকম্যানও পিছু হটবার পাত্র নন। ফলে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে একটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে যায়। এই যুদ্ধে ডা. স্টকম্যান একে একে হারাতে থাকেন গণমাধ্যম ও মালিক সমিতির সমর্থন। অসম এই যুদ্ধে একা ডা. স্টকম্যান ও তার পরিবার, সাথে আছে বন্ধুপ্রতিম নাবিক হরস্টার। সেই যুদ্ধের বয়ান নিয়েই এগিয়ে যায় নাটকটি।

 

ইবসেনের কালজয়ী  “এন ফোকেফিয়েন্দে” নাটকটির এডাপটেশন করার পিছনে মিলারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, চির প্রাসঙ্গিক এই বিষয়বস্তুকে সময়োপযোগী একটি পরিবেশে পুন:উপস্থাপন করা যেটি মিলার খুবই সুনিপুণ ভাবে করতে পেরেছেন। সংলাপে ভিক্টোরিয়ান যুগের কাব্যিকতা ও অতিনাটকীয়তার জায়গায় এনেছেন সমকালীন ব্যবহারিক ইংরেজি। ফলে আধুনিক পাঠকের অভিরুচির সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এর পাশাপাশি মিলার নাটকটি লেখার সময় ইবসেন এখন বেঁচে থাকলে কীভাবে নাটকটি লিখতেন সেই বিষয়টিও মাথায় রেখেছে, ফলে নাটকটিতে ইবসেনের মৌলত্ব অক্ষুন্ন থেকেছে, পাশাপাশি মিলারের আধুনিক চিন্তাচেতনা নাটকটির শোভাবর্ধনও করেছে। চরিত্রগুলোও একমাত্রিক বা একঘেয়ে হয়ে যায়নি। আমি পাঠক হিসেবে নাটকটি পড়ার সময় রীতিমত কিরস্টেন ঝর্ণার সেই শহরেই হারিয়ে গিয়েছিলাম, তাই নাটকটি স্বল্প আয়তনের হওয়াতে বেশ একট আক্ষেপই হয়েছিলো আমার।

পরিশেষে বলি, আমার মনে হয় এই নাটকটির সবচেয়ে বড় শক্তি এটির প্রাসঙ্গিকতায়। আর এই প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকার মুখ্য কারণ হলো নাটকটির বিষয়বস্তু। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভ্রান্ত ধারণার বিপরীতে এক ব্যক্তির আবিষ্কৃত সত্য – মূলত এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই নাটকটির গল্প, নাটকটির এগিয়ে যাওয়া। পুরোটা নাটকে লেখক খুঁজে যান একটি প্রশ্নের উত্তর- সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভ্রান্ত ধারণাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দিতে উদ্যত যে ব্যক্তি, যে ব্যক্তি একাই সত্যের বাহক, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো সেই মানুষটির মুখোমুখি হতে সমাজ কি আদৌ সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে পারে? তবে সমাজের প্রতিক্রিয়া যেমনই হোক, সামষ্টিক মিথ্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম অনিবার্য। সেই সত্যকে স্বীকার করেই মিলারের ডা. স্টকম্যান বলেন, “You are fighting for the truth, and that’s why you’re alone. And that makes you strong. We’re the strongest people in the world….and the strong must learn to be lonely.”

পর্যালোচকঃ সুবাহ বিনতে আহসান

*Any views expressed in this review are that of the author’s only. This is not necessarily a reflection of the viewpoint of YPF. We welcome the sharing of all ideas as long as they follow our guidelines.

Leave a Comment

Scroll to Top