ওয়েবিনার আপডেটঃ রাজনৈতিক উত্তরণে গণসংহতি আন্দোলন কি ভাবছে?

লিখেছেনঃ আরমান মোহসিন ইয়ামিন

“সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব, কেড়ে নেয়া সম্ভব” – গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জনাব জোনায়েদ সাকি’র এমন বক্তব্য স্পষ্টতই ইঙ্গিত করে বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান। দলীয় আদর্শ অনুযায়ী কোনো দল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ বাতিলের পক্ষে থাকলেও কোনো কোনো দল সংস্কারেই দেখছেন ভালো ফলাফল। ক্ষমতাশীল কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে বাংলাদেশের বাস্তবতায় আদৌ কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। তবে নির্বাচনকে ঘিরে দলগুলো নাগরিকদের যে প্রতিশ্রুতি দেয় তার বেশীরভাগই যে ক্ষমতায় গেলে বাস্তবায়িত হয় না তা নিয়ে খুব কম মানুষের মাঝেই দ্বিমত রয়েছে। জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে ধরনের পদক্ষেপ আশা করে তার ঠিক কতখানি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে প্রতিফলিত হয়? এই বিষয়টি জানতে গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাত ৮:০০ থেকে রাত ৯:১৫ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় “রাষ্ট্র কাঠামোর উন্নয়ন: রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং রূপরেখা” নামক ডায়লগ সিরিজের দ্বিতীয় ওয়েবিনার পর্ব।

ইয়ুথ পলিসি ফোরামের পলিটিকস এন্ড গভার্ন্যান্স টিম কর্তৃক আয়োজিত “রাষ্ট্র কাঠামোর উন্নয়ন: রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও রূপরেখা” নামক ডায়লগ সিরিজের শুরুতে আমন্ত্রিত অতিথি ও মডারেটরকে স্বাগতম জানিয়ে দ্বিতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন নূসান্তা সামায়েল অদ্রি, ডেপুটি লিড – পলিটিক্স এন্ড গভর্নেন্স টিম, ইয়ুথ পলিসি ফোরাম। আলোচনায় মডারেটর হিসেবে ছিলেন প্রথম ওয়েবিনারের মডারেটর, ওয়াইপিএফের সম্মানিত এডভাইজর ড. আসিফ শাহান। তবে এবার তাঁর সাথে আমন্ত্রিত রাজনৈতিক দল হিসেবে ছিলো গণসংহতি আন্দোলন। সময়ে সময়ে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনার পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মানে এই দল ২০০২ সাল থেকে “পরিবর্তন সম্ভব,পরিবর্তন চাই” স্লোগানের মাধ্যমে পরিবর্তনকামী প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি সমূহের ঐক্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট আছে। “গণসংহতি আন্দোলন” থেকে অনুষ্ঠানে কথা বলতে যুক্ত হয়েছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রধান সমন্বয়ক জনাব জোনায়েদ সাকি। দেশের বিদ্যমান বিভিন্ন জটিলতা মোকাবেলায় রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোর কি কি সমস্যা রয়েছে এবং সেই সমস্যার সমাধানে গণসংহতি আন্দোলন কি ভাবছে তা দিয়েই শুরু করা হয় অনুষ্ঠানের মূল পর্ব।

বক্তব্যের শুরুতে জোনায়েদ সাকি একটি আদর্শিক  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের যে প্রধান পার্থক্য গুলো দেখতে পান তা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন “গণতান্ত্রিক সরকারের একটি মূল বৈশিষ্ট হলো জনগণের প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করবে কিন্তু  কখনো জনগণকে ছাপিয়ে প্রভুত্ব করবেন না।” কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় ১৯৭২ সালের সংবিধানে জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস করা হলেও ক্ষমতাকাঠামো যখন নিরুপন করা হয় তাতে দেখা যায় নির্বাহী বিভাগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত হয়। জোনায়েদ সাকি মনে করেন ১৯৭২ সালে সংবিধান এমন ভাবে তৈরি হয়েছে যাতে সরকার চাইলেই জনগণের সকল অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এতে সরকারের জবাবদিহিতার যে জায়গাটি রয়েছে তা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আমরা সরকারের প্রত্যেকটি শাখায় জবাবদিহিতার যে অনুশাসন থাকার কথা তা দেখতে পাইনা। বিচারবিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের অনুগ্রহের পরিবর্তে একটি নিরপেক্ষ নিয়োগ কমিশনের কথা উঠে আসে জনাব সাকির বক্তব্যে। নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যদি আমরা মনোনিবেশ করি, তাতে স্পষ্ট হয়ে আসে সরকারি দলের অনুগ্রহ ছাড়া নিয়োগের সুযোগ নেই। কেননা প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ সকল কমিশনার নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি, সাধারণত যিনি নিজেই ক্ষমতাশীল দলের একজন সমর্থক। ফলে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে যারা নিয়োগ পাবেন তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকা খুব একটি অবাক কিরা বিষয় নয়।

বাংলাদেশের ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন সম্পর্কে বিএনপি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে গণসংহতি আন্দোলনের সামঞ্জস্যতা  জানতে চাইলে জনাব সাকি তাদের অবস্থান ব্যাক্ত করেন। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধিনে নির্বাচন ও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্করণ যার মাঝে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব। পাশাপাশি গণসংহতি আন্দোলন ২০১৮ সাল থেকে তাদের দলের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি দাবি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যার মাঝে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট আমরা আমাদের পাশবর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান সহ উন্নত দেশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রেও দেখতে পাই। এ ধনের সংসদীয় ব্যাবস্থায় সাধারণত সংসদের উচ্চ কক্ষ আইন প্রনয়ণ ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তদারকি করে থাকে এবং নিম্ন কক্ষ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ ও অনুশাসনের দায়িত্ব পালন করে থাকে। বাংলাদেশ আয়াতনের দিক থেকে ছোটো হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য সমস্যার জন্য দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যাবস্থা এই দেশের বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব বললেও ভুল হবে না। সংখ্যনুপাতিক নির্বাচন ব্যাবস্থার দাবি গণসংহতি আন্দোলনের একটি অন্যতম দাবি হিসেবে উঠে এসেছে। স্থানীয় সরকারের বাজেট প্রয়োয়ন ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরনে তাকে মন্ত্রিসভার একজন হিসেবে গণ্য করা, প্রধানমন্ত্রীর ইম্পিচমেন্ট ব্যবস্থা প্রনয়ণ, দুই বারের বেশী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হতে না পারার বিধানের দাবি গণসংহতি আন্দোলন বেশ গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণসংহতি আন্দোলনের এই দাবিগুলো বাস্তবায়ন আসলে কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে সংশয় থাকলেও দাবিগুলো বাস্তবায়িত হলে যে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে তা নিয়ে তেমন একটা সংশয় থাকা উচিৎ নয়। উন্নত বিশ্ব, যেখানে আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যমান সেখানে আমরা এ ধরনের ব্যাবস্থা দেখতে পাই। ফলে গণসংহতি আন্দোলনের এই দাবিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের গণতন্ত্র চর্চা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ যথেষ্ট শক্তিশালী হবে বলেই প্রতিয়মান হয়।

আরমান মোহসিন ইয়ামিন ওয়াইপিএফ পলিটিক্স ও গভর্ন্যান্স টিম এর একজন অ্যাসোসিয়েট

Scroll to Top