মহানগর থেকে মরুভূমির পথে ঢাকা ও আমাদের ভাবনা

গত ৫৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ তাপদাহ দেখেছে মহানগর ঢাকা!

-কিন্তু কেন?

প্রশ্নটা করলেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে বুড়িগঙ্গার করুন দৃশ্য,কংক্রিট আর ইটের দেয়াল,আবর্জনার স্তূপ আর যানবাহনের কালো ধোঁয়া, একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন সবুজের হাহাকার, সাতমসজিদ রোডের গাছগুলোর নীরব কান্না কিংবা ধোলাই নদী হারিয়ে যাওয়ার নির্মম ইতিহাস সাথে আরও শুনতে পাবেন বৃক্ষ ও প্রাণী উজাড় করে শহরের শোভাবর্ধনের অলিক গল্প, অনুভব করবেন শহরের প্রাণহীনতা আর তীব্র তাপদাহে দগ্ধ মানুষের অসহায়ত্ব।

-তাপদাহ!

World Meteorological Organization এর মতে কোন অঞ্চলের গড় তাপমাত্রার তুলনায় সেই অঞ্চলের তাপমাত্রা ৫°সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে এবং তা যদি সর্বনিম্ন পাঁচদিন ব্যাপি চলমান থাকে তবে সেটাকে হিটওয়েভ বলা যাবে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে গ্রীষ্মকালে দেশের গড় তাপমাত্রা ৩৪° সেলসিয়াস এবং এটি বেড়ে ৩৬~৩৮° সেলসিয়াস হলে সেটিকে মৃদু, ৩৮~৪০° সেলসিয়াস হলে মাঝারি, ৪০~৪২° সেলসিয়াস এর ক্ষেত্রে তীব্র এবং ৪২° সেলসিয়াস এর উপর হলে তাকে অতি তীব্র তাপদাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বস্তুতঃ কোন একটি অঞ্চল Heatwave দ্বারা আক্রান্ত কিনা তা নির্ভর করে সেই অঞ্চলের মানুষের তাপমাত্রার সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার উপর।যেহেতু তাপমাত্রা ৩৫° সেলসিয়াস এর উপর থাকলে মানবদেহ শীতলীকরণ প্রক্রিয়া স্তিমিত হয় তাই অধিকাংশ দেশ-ই ৩৫° সেলসিয়াস কে হিটওয়েভ এর সর্বনিম্ন সীমা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।

-তাপদাহের অতীত ইতিহাসঃ

১৯৮১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত দেশের কোথাও Heatwave এর রেকর্ড না থাকলেও ২০১০~১৪ পর্যন্ত রাজশাহী, খুলনা, ঈশ্বরদী, চুয়াডাঙ্গা, রংপুর ও মোংলা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু হিটওয়েভ লক্ষ্য করা যায়। ২০১৬ তৎপরবর্তী সময়ে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে-ই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় মৃদু থেকে মাঝারি হিটওয়েভ প্রবাহিত হওয়ার প্রবণতা ছিলো সাম্প্রতিক দিনগুলোতে। তবে চলতি বছর ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে তাপদাহ রূপ নিয়েছে তীব্র থেকে অতি তীব্র পর্যায়ে।ঢাকার বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রায় ও দেখা যায় ব্যপক ফারাক।একই সময় আজিমপুর, শাহবাগ বা ক্যান্টরম্যান্ট এর তুলনায় গুলশান, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও ফার্মগেট এর তাপমাত্রা থাকে ২~৩°সেলসিয়াস বেশি।

-মহানগর কেন মরুভূমি?

নগর পরিকল্পনাবিদের মতে, নগরায়নের ক্ষেত্রে একটি শহরের অন্তত ২৫ ভাগ সবুজ এবং ১৫ ভাগ জলাশয়সহ অন্তত ৪০ ভাগ জায়গা ফাঁকা রাখা উচিত অথচ ২০২০ সালের এক গবেষনা অনুযায়ী ঢাকার ৮২ ভাগ জায়গাই ইট-কাঠ- কংক্রিটে মোড়ানো।এয়ার টাইট সুউচ্চ স্থাপনা, অপ্রয়োজনীয় গ্লাস আর এসির ব্যবহার, ডিজেল ও পেট্রোল চালিত ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের আধিক্য সর্বোপরি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সবকিছুর ভারে ক্লান্ত ঢাকা, তার সাথে অপরিকল্পিত স্থাপনা, শিল্প কলকারখানার দূষণ, নির্বিচারে সবুজ উচ্ছেদ ও জলাশয় ভরাট আর রাস্তা ঘেঁষে অবাধে নির্মাণ ও উন্নয়নের চাপ তো আছেই।

-তাপদাহ প্রশমনে আমাদের নগর-পরিকল্পনা

তাপদাহ প্রশমনের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বনায়ন ও জলাধার পুনরুদ্ধারে, পাশাপাশি কনক্রিট এর দেয়ালে ও রাখতে সবুজের আচ্ছাদন, ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে কমাতে হবে কাচের ব্যবহার, দুটি ভবনের মাঝে রাখতে হবে নিরাপদ দূরত্ব, ভবনের সামনে রাখতে হবে অন্তত ২৫ ফুট চওড়া রাস্তা যা নিশ্চিত করবে নির্বিঘ্নে বায়ুপ্রবাহ। কমাতে হবে কার্বন নিঃসরনকারী যানবাহন ও এসির ব্যবহার। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা ও শিল্পকলকারখানা। তাপদাহের সময়গুলোতে নগরবাসীর বিশ্রাম এর কথা মাথায় রেখে প্রতি এক কিলোমিটার পরপর স্থাপন করা যেতে পারে যাত্রীছাউনি, যেখানে থাকবে নিরাপদ পানির সুব্যবস্থা। বস্তুত, Heatwave এর প্রভাব রাতারাতি প্রশমিত করা সম্ভব না। তাই তাপদাহ মোকাবেলায় প্রয়োজন ব্যপক গণসচেতনতা। জনসচেতনতার অংশ হিসেবে Heatwave Early Warning System এর মাধ্যমে প্রতি ঘন্টার আবহাওয়ার আপডেট দেওয়ার পাশাপাশি প্রচার করতে হবে তাপদাহে কোন কোন কাজ গুলো এড়িয়ে চলতে হবে আর মেনে চলতে হবে কোন কোন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক পরামর্শ।

-তাপদাহের সময়টাতে নগরবাসীর জন্য আমাদের পরামর্শঃ

*দুপুর ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত যথাসম্ভব বাইরের কাজ গুলো এড়িয়ে চলুন, ঘরের সবচেয়ে শীতল স্থানটি খুজে বের করে সেখানে থাকার চেষ্টা করুন, বাইরে বের হলে হাল্কা রংয়ের, ঢিলেঢালা সুতি কাপড়ের পোশাক বেছে নিন, সঙ্গে ছাতা নিতে ভুলবেন না যেন!

*অতিরিক্ত তেল-মসলা-ফ্যাট ও উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলুন, চা কফি সফট-ডিংকস কিংবা অ্যালকোহল একদম-ই নয়, অতিরিক্ত ডিহাইড্রেশন এর ক্লান্তি এড়াতে পর্যাপ্ত পানি পান করুন আর শরীর শীতল রাখতে বারবার গোসল করুন।

*বিছানায় সুতি কাপড়ের চাদর ব্যবহার করুন, পরিবারের বয়স্ক ও অসুস্থ সদস্যদের খেয়াল রাখুন, বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন স্ট্রোক, উচ্চরক্তচাপ কিংবা ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে।

*সর্বোপরি, আপনার ঘরকে ঠান্ডা রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে ছাদবাগান, এছাড়া ঘরকে আরেকটু ঠান্ডা রাখতে ফ্যানের নিচে রাখতে পারেন ঠান্ডা পানির উৎস।

❝চলুন সকলে মিলে কাজ করি,পরিবেশবান্ধব-পরিচ্ছন্ন মহানগরী গড়ে তুলি।❞

References

  1. মোকারম হোসেন. (2022, May 31). দূষণে হতাশার নগরী ঢাকা. The Daily Star. https://bangla.thedailystar.net/%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF/%E0%A6%A6%E0%A7%82%E0%A6%B7%E0%A6%A3%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%A2%E0%
  2. ইফতেখার মাহমুদ. (2022, October 2). বছরে ঢাকার ক্ষতি প্রায় ৬০০ কোটি ডলার. প্রথম আলো. https://www.prothomalo.com/…/bangladesh/capital/xvrvbc5ypa
  3. উদিসা ইসলাম. (2023, April 15). ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত দিন. প্রথম আলো. https://www.prothomalo.com/…/ban…/environment/37sb078ol3
  4. নূর মোহাম্মদ. (2023, April 19). তাপীয় দ্বীপের ‘হিট বোম্ব’ হচ্ছে ঢাকা. Dhaka Post. https://www.dhakapost.com/amp/exclusive/188125
  5. Heatwaves: How to stay cool. (2019, July 26). World Health Organization (WHO). Retrieved May 21, 2023, from https://www.who.int/…/item/heatwaves-how-to-stay-cool

এই পোস্টটি ওয়াইপিএফ গ্রাসরুট নেটওয়ার্কের নারায়ণগঞ্জ এনভয় দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। তারা হলেন –

১)মরিয়ম আক্তার খুশি
২)আমিরুস সালেহিন হামিম
৩)আমাতুল হাই
৪)সাদিয়া খানম
৫)লাবীবা আহমেদ
৬)আমেনা আক্তার খুশবু
৭)শুভ্র দে নয়ন

Scroll to Top