বই রিভিউঃ রাশিয়ার চিঠি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (পূর্বাশা পৃথ্বী)

রবীন্দ্রনাথের লেখার উপযুক্ত পর্যালোচনা করা আমার সাধ্যাতীত। তবে উপলব্ধি নিয়ে তো কথা বলাই যায়! এই যে আজকালকার হোয়াটসএপ মেসেঞ্জারের যুগে বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে আমাদের পরস্পরকে লিখিত বার্তা দেয়ার ধরনটাও কত বদলে গেছে। অথচ, আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে রবি ঠাকুরের পরিবার পরিচিত পরিজনের জন্য লেখা  ১৪টি  চিঠি নিয়েই বের হয়ে গেল একটা গ্রন্থ, যা আজ সাহিত্যের জগতে বহুল জনপ্রিয় এবং মূল্যবান, “রাশিয়ার চিঠি” নামে।

রুশ বিপ্লবের একযুগ পার হয়েছে মাত্র, এমন সময় রাশিয়া ভ্রমণে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের যে অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, দর্শন এবং পরিকল্পনা, সব ই ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনীতে। ফুটে উঠেছে স্বদেশভক্তি, আফসোস, দুঃখ, অপারগতা।

রুশ বিপ্লবের পর উত্তোরত্তর কমিউনিস্ট আদর্শে এগিয়ে চলেছে সোভিয়েত। সেসময় ভারতবর্ষ এবং বাংলার অবস্থা সুখকর নয়। এমন সময়ে বিদেশ ভ্রমণ করে রবি ঠাকুর উপলব্ধি করলেন, তিনি এতদিন অন্য জগতে বাস করছিলেন, যা তিনি অসাধ্য ভাবতেন, তা সাধিত হচ্ছে রাশিয়ায়। রাশিয়ার চিঠি পড়লে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শেষ বয়সে রবি ঠাকুরের চিন্তার বিচরণক্ষেত্রের বিশাল অংশজুড়ে ছিল শিক্ষাব্যবস্থা ও কৃষিব্যবস্থা। বিভিন্নজনকে বিভিন্ন চিঠি তে তিনি বারবার বর্ণনা করেছেন, কীভাবে সমাজতন্ত্রের আদর্শে রাশিয়ার চাষা মজুর মুটের নিজেদের বিকশিত করছে। প্রসঙ্গ এসেছে সমবায় কৃষি পদ্ধতির, কৃষিযন্ত্রের। আধুনিক কৃষি উপকরণের প্রয়োজনীয়তা, এবং তা সহজলভ্যকরণে কী কী বাধা রয়েছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।

ক্যাপিটালিস্ট বৃটিশ শাসনে কৃষকের অবস্থা দেখে জমিদার রবীন্দ্রনাথ অনেক হা হুতাশ তো করেছেন, কিন্তু তিনিও ভাবতেন শ্রমিক, মুটে, মজুর, কৃষক দের জন্মই হয়ত আজীবন অবহেলিত হয়ে সেবাব্রত পালন করা, এর নিরসনের কোনো উপায় নেই। কিন্তু আগাগোড়া সকল মানুষ্কে সমান ভাবে জাগিয়ে তোলা সম্ভব, সেই ভাবনা প্রথম অন্তরে সাড়া জাগালো যখন তিনি রাশিয়া ভ্রমণে গেলেন। কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার প্রতি বিমোহিত হলেন। বুঝলেন, অবকাশ আনন্দ শুধু এলিট সমাজের জন্য নয়, মনুষ্যত্ব ও সভ্যতা পরিপুষ্ট হয়, যখন সকলের অবকাশ নিশ্চিত হয়।

রাশিয়ার চিঠি কিন্তু শুধুই কবির ঢালাও অনুভূতি নয়। চিঠিতে রবি ঠাকুর লিখেছেন নিজের বাল্যকালের কথা, লিখেছেন ইতিহাসের নানান অংশও। রাশিয়ায় গিয়ে তাঁর গভীরভাবে ফরাসী বিদ্রোহ নিয়ে তাঁর চিন্তার প্রতিফলন সামনে এসেছে। তৎকালীন ভারতের গণমাধ্যম নিয়ে রাজনীতিও তিনি সুকৌশলে চিত্রায়ণ করেছেন চিঠিতে – “অথচ আমাদের বিরুদ্ধ বচন জগতে ব্যপ্ত করবার সকল প্রকার উপায় এদের হাতে… কেননা আজকের দিনের জনশ্রুতি সমস্ত জগতের কাছে ঘোষিত হয়, বাক্যচালনার যন্ত্রগুলো যে সব শক্তিমান জাতির হাতে, তারা অখ্যাতি ও অপযশের আড়ালে অশক্তজাতীয়দের বিলুপ্ত রাখতে পারে।”

ভ্রমণ শুধু মানুষের আনন্দের জন্য নয়,ভ্রমণ বদলে দিতে পারে দৃষ্টিভঙ্গি, দিতে পারে নতুন নতুন ধারণা। যেমনটা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই হলো। শান্তিনিকেতনে তাঁর স্বপ্নের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নিয়ম প্রবর্তন করেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, “পাঠবিভাগের চরম লক্ষ্য হচ্ছে পরীক্ষায় পাস করা’’, “কিন্তু ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না”। তত্ত্বের সাথে প্রাত্যাহিক জীবনের সংযোগ না ঘটলে শিক্ষার উদ্দেশ্য বিফলে যায়। তাঁর মতে কার্যকরী ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায় থেকেই জনকল্যাণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা,আচার ব্যবহার চরিত্র সবকিছুই পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও চর্চার আওতায় আনা প্রয়োজন।

এজন্য শিক্ষাবিদ, স্বাস্থ্যবিদ, কৃষিবিদ,  নীতিনির্ধারকদের জিগীষা নিয়ে দেশ বিদেশ ভ্রমণ করে সেসব অঞ্চলের নানান ব্যবস্থা সম্পরকে জানাটাও জরুরি মনে করে তিনি যেমন বলেন, “আমাদের কর্মীরা যদি এখানে এসে কিছুটা শিক্ষা করে যেতে পারত, তাহলে ভারি উপকার হত।’’, তেমনিভাবে এও বলেছেন, শুধু বিদেশের পাঠশালা থেকে সংগৃহীত তত্ত্ব দিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়, দেশের মানুষের চাহিদা ও স্থানীয় পরিস্থিতিও অনুধাবন করা প্রয়োজন। “আমাদের দেশ বিদেশিদের হাতে আছে একথা নিয়ে আক্ষেপ করা, উত্তেজিত হওয়া, কবিতা লেখা, খবরের কাগজ চালানো সহজ। কিন্তু দেশের লোক আমাদের আপন এ কথা বলবামাত্র তার দায়িত্ব স্বীকার করে নিতে হয়, কাজ শুরু হয় সেই মুহূর্তে ” এটি কবির আত্মোপলব্ধিই বটে।

চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ল এন্ড অর্ডার নিয়ে তার ভাবনাও। কেন তা কার্যকরী হচ্ছে না, শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাবের মূল কারণ সামনে নিয়ে এসেছেন তিনি।শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অসন্তোষ, সাধারণের ত্রুটি সব কিছুই সামনে নিয়ে এসেছেন রাশিয়ার সাথে নিজ দেশের চিত্র তুলনা করে। কুশিক্ষা, বৈষম্যসহ নানান নেতিবাচকতার অবসান করা বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার প্রশংসা আর তৎকালীন ভারতবর্ষের দুর্দশা,  সাম্প্রদায়িক জাতিবিদ্বেষ নিয়ে আশংকা, নিজের ও নিজেদের ব্যর্থতা ও অনুতাপ, ইউরোপের সাথে রাশিয়ার পার্থক্য বারংবার প্রকাশিত হয়েছে কবির শব্দচয়নে

চিঠিতে রবি ঠাকুরের আরেকটি অভিব্যক্তি আমার খুব ভাল লেগেছে, “ব্যাক্তিগত হিতকে সাধারণ হিতের অনুগত করে তোলবার চর্চা রাষ্ট্রীয় বক্তৃতামঞ্চে হতে পারে না, তার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়, সেই ক্ষেত্র আমাদের আশ্রম।” অর্থাৎ শুধু অভিযোগ আর  আফসোসের বেড়াজালে তিনি সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি। যেমনটা তিনি দেশকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেন, তারই সম্পূর্ণ একটি রূপ দিতে চেয়েছেন বাস্তবে, ছোট্ট আয়তনে, শান্তিনিকেতনের শিক্ষাব্যবস্থায়।

তবে রবি ঠাকুর যে সোভিয়েতের কমিউনিস্ট শাসনপদ্ধতির প্রতি অন্ধভাবে বিমুগ্ধ হয়েছেন, তা কিন্তু নয়। গ্রন্থপ্রকাশের সময় উপসংহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, যেখানে ব্যষ্টি উপেক্ষিত, সেখানে সমষ্টির উন্নতি দীর্ঘদিনের জন্য স্থায়ী নয়। বলশেভিক নীতি সাময়িক ভাবে সমাজের রুগ্ন অবস্থার সহায় হতে পারে তবে তা নিত্যকালের জন্য নয়, যার বাস্তব প্রমাণ আমরা পরবর্তীকালে দেখেছি।

চিঠিগুলো আজ থেকে বহু যুগ আগে ব্যক্তিপ্রাপকের উদ্দেশ্যে লেখা লেখকের নিজ চিন্তার প্রকাশ হলেও, আজকের সমাজের সাথেও অনেক বিষয় বহুলাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ । আজকের যুগেও বাঙালী জনসাধারণ, শাসকগোষ্ঠী, নীতিনির্ধারক, শিক্ষার্থী সকলের জন্য স্পষ্ট কিছু বার্তা তুলে ধরে রাশিয়ার চিঠি। পাশাপাশি, কবি এই বলে আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়ে শেষ করেন তাঁর চিঠি – তারুণ্য ও যৌবনই পারে সমাজে পরিবর্তন আনতে।

পর্যালোচকঃ পূর্বাশা পৃথ্বী

Leave a Comment

Scroll to Top