বাংলাদেশে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারের প্রেক্ষাপট : জেন্ডার সমতা, জেন্ডার স্টেরিওটাইপ এবং জেন্ডার বায়াস

লিখেছেনঃ সামিয়া তাহসীন হক

বাংলাদেশের সংবিধান জনসাধারণের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। নারীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যুক্তিসঙ্গতভাবে এদেশে শক্তিশালী আইন ও নীতিকাঠামোর অস্তিত্ব রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে CEDAW (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women) সম্মেলনে স্বাক্ষর করে এবং এর ধারাগুলো বাস্তবায়ন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। 

CEDAW এর অনুচ্ছেদ ১৬ অনুযায়ী নারীরা তাদের সন্তানদের সংখ্যা এবং গর্ভধারণের সময়ের ব্যবধানের বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখেন। একই সাথে এই অধিকারগুলো প্রয়োগ করতে তাদের যেনো প্রয়োজনীয় তথ্য ও শিক্ষার অ্যাক্সেস থাকে – এই বিষয়টি নিশ্চিত করে৷ জেন্ডার সমতা, জেন্ডার স্টেরিওটাইপ এবং জেন্ডার বায়াস বাংলাদেশে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারের ল্যান্ডস্কেপ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই আন্তঃসংযুক্ত দিকগুলি স্বাস্থ্য পরিসেবাগুলিতে নারীদের অ্যাক্সেস, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং বিভিন্ন লিঙ্গের ব্যক্তিদের সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। 

জেন্ডার সমতা এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার:

সকল ব্যক্তির জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার অর্জনের ভিত্তি হচ্ছে জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরণ। বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা অর্জনের একটি প্রধান দিক হচ্ছে স্বাস্থ্য পরিসেবা এবং এই সংক্রান্ত তথ্য অ্যাক্সেসের ক্ষেত্রে পুরুষ, নারী এবং জেন্ডার সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যগুলিকে সমাধান করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাতৃত্বকে অগ্রাধিকার দেয়া সামাজিক নিয়মের কারণে নারীরা পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক পরিসেবা অ্যাক্সেস করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। এই সামাজিক ব্যবস্থায় নারীর গর্ভনিরোধক এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক পদ্ধতিগুলো ট্যাবু হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেতে নারীরা অপারগ থাকে।

জেন্ডার স্টেরিওটাইপস এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত:

জেন্ডার স্টেরিওটাইপগুলো সামাজিক নিয়ম ও প্রত্যাশার মধ্যে গভীরভাবে জড়িত। একইসাথে এগুলো প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। এই স্টেরিওটাইপগুলি জেন্ডারের উপর ভিত্তি করে মানুষের ভূমিকা ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে দেয়, যা যৌন স্বাস্থ্য এবং প্রজননের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবের পরিচয় দেয়। যেমন: সন্তানের লালনপালন শুধুমাত্র মায়ের দায়িত্ব – এই ধরনের জেন্ডার স্টেরিওটাইপ জেন্ডার সমতা অর্জনের পথে বাধাস্বরূপ। 

প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ক সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জেন্ডার স্টেরিওটাইপগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা এবং নির্মূল করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য সেক্স এডুকেশন চালুর বিকল্প নেই। স্কুল-কলেজে সেক্স এডুকেশন চালু করা হলে সেটি তরুণদের তাদের প্রজনন অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিকভাবে জানাতে পারবে। দায়িত্ব বন্টন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে জেন্ডার নির্বিশেষে সকলের অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে পুরো সমাজকে অবহিত করা এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে যেখানে ট্যাবু ভেঙ্গে সকলে যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। 

জেন্ডার বায়াস এবং স্বাস্থ্য পরিসেবাগুলিতে অ্যাক্সেস:

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যৌন ও প্রজনন পরিসেবার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অ্যাক্সেসকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্যখাতে জেন্ডার বায়াস বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পেতে পারে, যেমন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা সকলকে সমান সেবা দেয়ার বদলে অথবা  নারী বা জেন্ডার সংখ্যালঘুদের তুলনায় পুরুষদের স্বাস্থ্য উদ্বেগকে অগ্রাধিকার দেন।  ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা প্রজনন স্বাস্থ্য পরিসেবাগুলি অ্যাক্সেস করার সময় বৈষম্য এবং পক্ষপাতের সম্মুখীন হন, যার ফলে তারা উপযুক্ত সেবা থেকে বঞ্চিত হন। 

জেন্ডার বায়াস মোকাবেলা করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের সংবেদনশীলতা প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা, অচেতন পক্ষপাত (subconscious bias) সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা চাওয়ার সময় সকল ব্যক্তিকে সম্মান ও মর্যাদার সাথে আচরণ করা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

জেন্ডার সমতা, জেন্ডার স্টেরিওটাইপস এবং জেন্ডার বায়াস পরস্পর গভীরভাবে জড়িত বিষয় যা বাংলাদেশে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্য পরিসেবা এবং প্রজনন সংক্রান্ত বিষয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অ্যাক্সেস প্রদানের জন্য জেন্ডার সমতা অর্জন করা একটি অবশ্য প্রয়োজন। প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনাকে উন্নীত করতে চ্যালেঞ্জিং জেন্ডার স্টেরিওটাইপ ও জেন্ডার বায়াস বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন, যা পরবর্তীতে সকলের জন্য ইনফরমড চয়েজ তৈরি করতে ভূমিকা রাখতে পারে। 

এই আন্তঃসম্পর্কিত দিকগুলিকে সমাধান করার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে পারে যেখানে সমস্ত ব্যক্তি তাদের লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সুরক্ষিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পরিসেবাগুলিতে সমান অ্যাক্সেস পাবে। মানুষদের তাদের যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা, সিন্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেওয়া ও ব্যক্তিগত সিন্ধান্ত বাস্তবে পরিণত করা  – সবার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারের জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, শিক্ষাবিদ এবং সুশীল সমাজের সহযোগিতা প্রয়োজন। পারস্পরিক সম্মিলিত দায়িত্ব নেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা আনা সম্ভব। পাশাপাশি জেন্ডার স্টেরিওটাইপ এবং বায়াস নির্মূল করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে না।

সামিয়া তাহসিন হক ওয়াইপিএফের জেন্ডার এন্ড ইনক্লুশন টিমের একজন অ্যাসোসিয়েট

ফিচারড ইমেজ কার্টেসিঃ The Jakarta Post

Scroll to Top