লিখেছেনঃ সাদ ইবনে ওয়ালিদ
“Man begets, but land does not beget.”
– Cecil Rhodes
পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত মানুষের আবির্ভাব ঘটলেও পৃথিবীর আয়তন ধ্রুবক। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২.১৮ গুণ বৃদ্ধি পেলেও আয়তনের উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন ঘটে নি। অর্থাৎ সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্র নির্দিষ্ট হলেও চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণও প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করতে না পারার কারণে সৃষ্টি হয়েছে অনাহার, দুর্যোগ, উন্নয়নের বৈষম্য। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন (১৯০৮-১৯৭৩) বলেছিলেন,
“The hungry world cannot be fed until and unless the growth of its resources and the growth of its population come into balance.”
অর্থাৎ অতিরিক্ত জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের একমাত্র প্রতিকার হলো সম্পদের উৎস বৃদ্ধি করা। যখন অতিরিক্ত জনসংখ্যার সাথে সম্পদের পরিমাণ সাম্যবস্থায় থাকবে কেবলমাত্র তখনই সকল মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটবে। এমতাবস্থায় সকল নাগরিককে মানবসম্পদে পরিণত করার মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।
মানবসম্পদ ও উন্নয়ন : ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শিল্পবিপ্লব এর কারণে মূলত মানুষকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করার ধারণা তৈরি হয়। দক্ষ শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে প্রভাব রাখতে সক্ষম। ঠিক তেমনি যখন দেশের কোন একজন নাগরিক নিজের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখে তখন তাকে মানবসম্পদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। নাগরিকের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতার উপর নির্ভর করে ঐ দেশের রাজস্ব আয়। তাই যখন দেশের প্রতিটি নাগরিক মানবসম্পদে পরিণত হয় তখন দেশের সার্বিক উন্নয়নও সাধিত হয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পল জে. মেয়ার ( Paul J. Meyer) বলেছেন,
“The greatest natural resources of our country is it’s people.”
অর্থাৎ দেশের মানুষদের যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে একক উন্নয়নের মাধ্যমে সামগ্রিক উন্নয়নও সম্ভব। তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশের সকল নাগরিকের থেকে যথার্থ সেবা পাওয়া সম্ভব হয় না। যার কারণে দেশের একটি বৃহত্তম অংশ দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে না।
মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতাসমূহ : জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপির ২০২০ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন পরিস্থিতি মধ্যম সারির। এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়ে ১৮৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। মানুষকে সম্পদে পরিণত করতে অন্যতম বাধা হলো দারিদ্র্য এবং অশিক্ষা। সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোরাম (সানেম) এর এক জরিপের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সার্বিক দরিদ্রতার হার ২১.৬ শতাংশ থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ৪২ শতাংশে। দেশে চরম দারিদ্র্যের হার প্রায় ২৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নাগরিক তাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারে নি। এই চরম দারিদ্র্যের কারণে তাদের পক্ষে নিজেদের উৎপাদনশীলতা অনুসন্ধানের কোন জায়গা থাকে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭০ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের প্রায় ২৫.৩ শতাংশ মানুষ এখন পর্যন্ত পড়তে ও লিখতে জানে না। উচ্চশিক্ষা সকলের জন্য প্রয়োজনীয় না হলেও দেশের প্রতিটি নাগরিকের সাক্ষরতা নিশ্চিত করা অতীব জরুরী। লিখতে ও পড়তে পারতে যারা অক্ষম তাদেরকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করা কঠিন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ এর হিসাবমতে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। এই যে বেকারত্বের প্লাবন, এর পেছনে মূলত দায়ী হলো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে চাকরির মেলবন্ধন না থাকা। চাকরিক্ষেত্রে যেসকল কারিগরি দক্ষতা প্রয়োজন তা দেশের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গন থেকে যথার্থভাবে পায় না। যার কারণে দেশের বৃহৎ একটু অংশ যোগ্যতা অনুযায়ী দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হয় না।
প্রতিবন্ধকতাসমূহ উত্তরণের পথ : প্রথমত, দেশের সকল নাগরিকের প্রাথমিক শিক্ষা এবং সাক্ষরতার হার সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, জনগণের কল্যাণে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তখনই কার্যকর করা সম্ভব হবে যখন তারা প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। এছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তার প্রায়োগিক সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হবে। চাকরি ক্ষেত্রে যে দক্ষতা প্রয়োজন তা যেন শিক্ষাঙ্গনে প্রদান করা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা প্রদানের সচেতন হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের পরিকল্পিত উপায়ে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং যথোপযুক্ত বেতন নিশ্চিত করতে হবে। William F. Glueck- এর মতে, “মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা হচ্ছে ঐ সকল সিদ্ধান্ত ও কার্যাবলী, যা সংগঠন ও কর্মীদের কাজে উৎসাহিত করে।” শ্রমিক এবং দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষদের যখন যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হবে তখন ঠিকই তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও শ্রমের সাথে যুক্ত হওয়ার পূর্বে কিংবা পরে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
তৃতীয়ত, অধিক পরিমাণে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু করতে হবে। বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৬৭৫টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এই সংখ্যার পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করা জরুরি। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি খাতে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ শিশু শ্রমে জড়িত। আইএলওর তথ্যমতে, শুধু ঢাকাতেই দেড় লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। এইসকল শিশুদের কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার সাথে যুক্ত করতে হবে।
চতুর্থত, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি প্রদান করতে হবে। বর্তমানে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ৭৮ লাখ উদ্যোক্তার মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা। অর্থাৎ গৃহকর্মের পাশাপাশি নারীরাও দেশের দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু মূলধনের অভাবে অনেকেই ইচ্ছা থাকলেও ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলতে পারে না। উদ্যোক্তাদের বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের দেশের একটি বৃহৎ অংশকে দক্ষ মানবসম্পদ পরিণত করা সম্ভব।
বর্তমান সময়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির স্বপ্ন পূরণের অন্যতম উপায় হলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি। কেননা মানবসম্পদ উন্নয়নই হলো দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। তাই দেশের প্রত্যেকটি জনগণকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার মাধ্যমে সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
সাদ ইবনে ওয়ালিদ
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সহযোগী সম্পাদক, বাংলা এডিটোরিয়াল ও কন্টেন্ট,
ইয়ুথ পলিসি ফোরাম।
References :
১. মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিচিতি, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
Link :
https://documentcloud.adobe.com/link/track?uri=urn:aaid:scds:US:68c11bfe-afac-4c25-bf2e-e9e92d6d7519
২. দেশে দারিদ্র্যের হার কত?
২৭ জানুয়ারি ২০২১, দৈনিক যুগান্তর
৩. ‘দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭০ শতাংশ’
০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০, দৈনিক ইত্তেফাক
Link:
৪. মানব সম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান
২৪ জানুয়ারি, ২০১৭, দৈনিক ইনকিলাব
৫. বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা কত?
নিউজ বাংলা ২৪
Link: