লিখেছেনঃ মো:সিফাতুল ইসলাম, মোড়েলগঞ্জ,বাগেরহাট থেকে
পটভূমি:
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা বাগেরহাট জেলা আর তাতে মাকড়সার জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদী ও অসংখ্য খালে জোয়ার ভাটার খেলা চলে রাতদিন।কিন্তু স্থানীয় জনগণের বেহাল দশা কারণ এই বিপুল জলরাশি লবণাক্ত এবং তার এক ফোঁটা পানি পানের এবং রান্নার কাজে লাগে না।এজন্য বিভিন্ন সময় দক্ষিণ অঞ্চলে সরকারী উদ্যোগে পুকুর খনন করে , নলকূপ বসিয়ে সুপেয় পানির চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হয়েছে।সারা দেশের সরকারি বেসরকারি খাতের পুকুর–দিঘী ও বুরোপিট এর পরিসংখ্যান (২০০৩) তথ্য অনুসারে বাগেরহাট জেলায় মোট সুপেয় পানি পানের জন্য চিহ্নিত পুকুর এর সংখ্যা ৫৬৬ টি এর মধ্যে ৬০ টি(১০.৭০%) সরকারি এবং ৫০৬টি (৮৯.৪০%) বেসরকারি।বাগেরহাট জেলার নলকূপের সংখ্যা ২০,০৫২টি, গভীর নলকূপ ৫,১৯৯ টি (সচল–৫,১৪৩টি, অকেজো–৫৬ টি), অগভীর নলকূপ ১৪,৮৫৩টি (সচল–১২,৯৩০টি, অকেজো–১,৯২৩টি)। তবুও এই সংখ্যাগুলো বাগেরহাট জেলার ১৫ লক্ষ মানুষের জন্য সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে অক্ষম। বাগেরহাট জেলা শহরে সুপেয় পানির সমস্যা তেমন না হলেও জেলার দক্ষিণে অবস্থিত উপজেলা সমূহের সুপেয় পানির সমস্যা ভয়াবহ রকমের প্রকট।ফলে এ অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং নিরাপদ পানির অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে।ভৌগলিক ভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস লেগেই থাকে তার উপর নিরাপদ সুপেয় পানির অভাব যা স্থানীয় জনগণের কাছে মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
কেন সুপেয় পানির অভাব:
১.পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির পুকুর এবং নলকূপের অভাব।
২. উপকূলীয় অঞ্চল বলে মাঝেমধ্যে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেরি বাঁধ ভেঙ্গে লবণাক্ত পানি ঢুকে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে যায়।
৩.বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগারের অভাব।
৪.সুপেয় পানি পানের জন্য চিহ্নিত পুকুরের পাশে অবস্থিত ফিল্টার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া।
৫.ভূতাত্ত্বিক কারনে অনেক স্থানে পানির কল স্থাপন করা যায় না ।
৬. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য জ্ঞানের অভাব।
নগর অঞ্চলে নিরাপদ পানির অভাবে প্রভাব :
বাগেরহাটের দক্ষিণের উপজেলা সমূহের সুপেয় পানির অভাব যতটা প্রকট ততটা বাগেরহাট জেলা শহরে নেই।ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে শহরাঞ্চলে পরিবারে যে পানি খাওয়া হয় তার এক তৃতীয়াংশেই উচ্চমাত্রার ই–কোলাই ব্যাক্টেরিয়া থাকে, যা ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ।শহরের বস্তি, দ্বীপাঞ্চল, উপকূলীয় ও জলাভূমিতে এই পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এসব জায়গায় বিশ্বাসযোগ্য পানির উৎস পাওয়া কঠিন।কলকারখানার বর্জ্যও পানি দূষিত করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাপ্লাইয়ের পানিও সরাসরি পান করা নিরাপদ নয়। জীবাণুযুক্ত বা দূষিত পানি পান করলে পানিবাহিত রোগের মধ্যে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জিয়ার্ডিয়া, টাইফয়েড, পলিওমায়েলাইটিস, লিভারের অসুখ বা জন্ডিস (হেপাটাইটিস–এ, হেপাটাইটিস–ই), কৃমি ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
প্রস্তাবনা ও উপসংহার:
১.খাস জমিতে পর্যাপ্ত পুকুর খনন করা , নলকূপ স্থাপন করা এবং সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের করা।
২.যে সকল এলাকায় ভূতাত্বিক কারনে নলকূপ বসানো সম্ভব হয় না সেখানে ভূতাত্ত্বিক গবেষণা করে নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা করা।
৩.বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণাগার তৈরি করা।
৪.টেকসই কাঁচামাল দিয়ে ফিল্টার বানানো এবং স্থানীয় সুবিধাভোগীদের সচেতন করা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
৫. পুকুরে জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি প্রবেশ থেকে রক্ষা করতে পুকুরের পাড় উচু করে বাঁধানো। এবং উপকূলে ভেরি বাঁধ দেয়া।
৬.স্থানীয় জনগণকে বর্ষার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের প্রশিক্ষণ প্রদান।
৭. খাস পুকুর,সরকারি নলকূপ,বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোকবল নিয়োগ।
৮. সমগ্র উপকূলীয় এলাকার সকল জনগণের সুপেয় পানির চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য ওয়াসার মত আলাদা সরকারি প্রতিষ্ঠান গঠন যা উপকূলীয় জনগণের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে কাজ করবে।
আমি আশা করি স্থানীয় জনগণ এবং সরকার মিলেমিশে কাজ করলে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণ সুপেয় পানির এই প্রকট সমস্যা থেকে উত্তরণ লাভ করবে।