লিখেছেনঃ মোঃ হাসান আল হোসেন, পাবনা সদর, পাবনা থেকে
ভূমিকাঃ
আমি আজকে যে সমস্যাটি আপনাদের সামনে তুলে ধরবো সেটা মূলত আমাদের প্রতি ঘর ঘরের গল্প, কিন্ত আশ্চর্য বিষয় হলো আমরা এ নিয়ে সবসময় সমস্যার সম্মুখীন হলেও ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করার জন্য বা বিষয়টার একটা সুরাহা করার জন্য খুব বেশি ইনিশিয়াটিভ নিই না। তাই দেখা যায়, অনেক ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করার পরও সমস্যাটির কার্যকর সমাধান প্রণয়নের জন্য এখনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। আমাদের দেশে শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড় একটি বাঁধা হলো বাজে প্যারেন্টিং। বাজে প্যারেন্টিং এর জন্য অগণিত শিশু-কিশোর-কিশোরী আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। তারচেয়ে আরো অনেক সম্ভাবনাময় মানুষ স্বপ্নের জলাঞ্জলি দিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগে কখনো ড্রাগস বা অপরাধের পথে পা বাড়াচ্ছে, কখনোবা রোবটের মতো অনুভূতিশূন্য জীবন যাপন করছে। তাছাড়া প্যারেন্টিং এডুকেশনের অভাবে নবদম্পতিরাও যথেষ্ট পীড়ন অনুভব করেন। এরফলস্বরুপ দেখা যায়, আমাদের দেশের প্যারেন্টিং স্ট্রেস ইন্ডেক্সের অবস্থাও অনেক শোচনীয়।
সমস্যাটির কারণ ও প্রভাবঃ
আমাদের দেশে প্যারেন্টিং এডুকেশনের প্র্যাকটিসটা নেই বললেই চলে। পাঠ্যক্রমে গ্রাহস্থ্য অর্থনীতিতে ২-১ টি অধ্যায় হয়তো থাকে। আর ইদানিংকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা ইউটিউবে র্যান্ডম কিছু ভিডিও বা আর্টিকেল দেখা যায়। কিন্তু সেগুলো অপ্রতুল। আবার পরিবারের মধ্যে প্যারেন্টিংএর বিষয়গুলো নিয়ে সদস্যদের মাঝে আলোচনার প্রবণতা খুব কম। আমি আমার এলাকা পাবনার প্রায় ৩৫ টি পরিবারকে পর্যবেক্ষণ করেছি। দেখা গেছে এই ধরণের ডিস্কোর্স তাঁদের মধ্যে হয় না বললেই চলে এবং শিশুর প্রতি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা অনেক সাধারণ। সমস্যাটি প্রথমত ফেইস করেন একটা নববিবাহিত দম্পতি। তাঁরা তাঁদের নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্যগত বা প্রতিপালনের কাজটি করতে গিয়ে অনেক মানসিক পীড়নের শিকার হন, কেবলমাত্র প্রশিক্ষণের অভাবে। এছাড়া অনেক সময় বাজে প্যারেন্টিং ফলাফলে সন্তানরা স্বাস্থ্যঝুকিতে পড়ে মারাও যায়। তারপরো পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বা প্রতিবেশীদের সহায়তায় দৈনন্দিন কাজকর্মের বিষয়টা তাঁরা সমলে নেন। কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় তাঁদের পক্ষে মানসিক পীড়ন সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে যার প্রভাব পড়ে সন্তানের মানসিক স্বাস্থের উপর। উপরন্তু আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা ভঙ্গুর ও দেশের অনেক মানুষ আর্থ-সামাজিক অনিরাপত্তায় ভোগেন এবং দেখা যায়, অনেক পরিবারই তাঁর সন্তান ও নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে স্ট্রাগল করেন। এমতাবস্থায় তাঁরা স্বভাবতই তাঁরা সন্তানের গুড প্যারেন্টিং বা তাঁদের মেন্টাল হেলথের প্রতি সচেতন থাকেন না। আরেকটা কারণ উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের দেশের পিতা-মাতাগণ সন্তানের একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি অনেক এগ্রেসিভ হয়ে থাকেন। এর পেছনে সন্তানের শিক্ষা সম্পন্ন করার মাধ্যমে পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনয়ন এবং নিজের স্বপ্ন সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করবার উচ্চাশা সবচেয়ে বেশি দায়ী। এমনটা কখনো না যে ভালো প্যারেন্টিং নিশ্চিত করার জন্য টাকা-পয়সা অপরিহার্য বিষয়। বরং এটা অনেকটা মানুষের আচরণগত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু যথেষ্ট জ্ঞান না থাকায় সন্তানরা বাজে প্যারেন্টিং এর শিকার হয়।
সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়ঃ
১. শিক্ষাক্রমে প্যারেন্টিং এডুকেশন আবশ্যিক বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা।
২. জাতীয় প্যারেন্টিং নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা।
৩. ভবিষ্যৎ মাতা-পিতা অর্থাৎ বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এবং কিশোর-কিশোরীদের সাথে দেশব্যাপী প্যারেন্টিং ডায়ালগ আয়োজন করা।
৪. সম্ভব হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ক কন্সাল্ট্যান্ট নিয়োগ করা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা। তাছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্যারেন্টিং এডুকেশন পৌঁছাতে স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে এবং তাঁরা মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করবেন।
৫. প্যারেন্টিং এডুকেশন সম্পর্কিত মানসম্পন্ন এবং পরিকল্পিত কন্টেন্ট নির্মান করা ও তা ন্যশনাল মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা।
সত্যি বলতে এ সমস্যাটি আমাদের সবাই অনুভব করি প্রতিনিয়ত। কিন্তু আমরা খুব বেশি কথা বলি না এ নিয়ে। তাই আমাদের সবার ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ পরিবার-প্রতিবেশীর সাথে কথা বলা উচিত। তাছাড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোরও এ নিয়ে কাজ করা উচিত। তাহলে হয়তো আমরা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবো।