বর্তমান যুবসমাজ, সামাজিক অবক্ষয় ও ভবিষ্যৎ ভাবনা

লিখেছেনঃ রাজু দাশ, বহদ্দারহাট, চট্টগ্রাম থেকে

সূচনা:

একটি দেশের যুবসমাজ যে কোন পর্যায়েই সে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ এবং তার প্রধান জীবনীশক্তি স্বরুপ । তবে বর্তমান প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও গতিশীল বৈশ্বিক অর্থনীতির এ যুগে চোখ বন্ধ করে একথা বলার আর সুযোগ নেই এবং এই বিষয়টিকে আরও ত্বরান্বিত করেছে যুবসমাজের ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতা, অসহিষ্ণুতা ও মানবিক অবক্ষয় তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে দায়িত্বশীল, সুশৃঙ্খল, ও সুপরিচালিত যুবসমাজই একটি দেশের সত্যিকারের সম্পদ স্বরুপ ও পরিবর্তনের কাণ্ডারী বাংলাদেশে জাতীয় যুবনীতি অনুসারে ১৮-৩৫ বছর বয়সের মধ্যকার জনগোষ্ঠীকে যুব হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং সে হিসেবে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এ যুবসমাজ যা সংখ্যায় প্রায় ৫ কোটির উপরে (যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বরাতে)

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দেশে এই বিশাল যুবসমাজ আজ এক অস্থির পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যুবসমাজের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, অসামাজিক কার্যকলাপ, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি ও অপব্যবহার, যৌন হয়রানি সর্বোপরি গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণের অনীহা এবং উদ্দেশ্যবিহীন চালচলন এসব কিছুই বর্তমান এই অস্থির পরিস্থিতির নির্দেশনা দিচ্ছে গণমাধ্যমের এক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে মাদকাসক্তির সাথে জড়িতের প্রায় ৮০ শতাংশের বয়স ১৫-৩৫ এর মধ্যে এবং দেশে এই মাদকাসেবীর পরিমান ৭০ লাখেরও বেশি (২১মে,২০১৮ বিবিসি বাংলা)

বাংলাদেশ সরকার প্রত্যক্ষভাবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর’ সৃষ্টি করার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে এবং ২৩টি ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের যুব সমাজের উন্নয়নের জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে তবে এসব পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রেই অপর্যাপ্ত এবং সময়ের সাথে অনুপযোগী বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে, তার সাথে বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতি এই প্রক্রিয়াকে আরো ব্যাহত করছে দেশের জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.২৭% যুব ও ক্রীড়া বাজেটের অন্তর্ভুক্ত আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এই বাজেটের পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না বা সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অপব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে এ ঘটনা বেশি লক্ষনীয়

আজকের যুবসমাজের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রধান কারণঃ

  • ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসম প্রতিযোগিতা ও মানসিক চাপ
  • বিকল্পধারার কর্মসংস্থানের অভাব, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ ও খেলাধুলার সুযোগের অভাব
  • গতানুগতিক শিক্ষা কার্যক্রম এবং বাস্তবধর্মী নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার অভাব
  • সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি,  অপব্যবহার ও উদ্দেশ্যহীন ব্যবহার
  • নোংরা রাজনৈতিক কার্যকলাপে সম্পৃক্ততা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মোহ

জনজীবনে যুবসমাজের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাবঃ

যুবসমাজের এভাবে বিপথে চলে যাওয়া এবং বেপরোয়া আচরণ যেমনি নগরজীবনের জন্য ভোগান্তির কারন তেমনি তা জাতীয় পর্যায়েও হতাশার ছাপ রাখছে যথাযথ পরিকল্পনা ও পরিচর্যার অভাবে আমরা আমাদের যুবসমাজকে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নিয়োজিত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি এবং তা আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই হুমকির সম্মুখীন করছে প্রতিনিয়ত যুবসমাজের অসামাজিক তৎপরতা দিনদিন বেড়েই চলেছে এবং তা সমাজে সৃষ্টি করছে অনিরাপত্তা, বাড়ছে ভোগান্তি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ প্রতিনিয়তই দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী পাশাপাশি যুবসমাজের এই বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পেরে আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ভাবেও বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, কারণ একটি দেশের যুবসমাজই পারে সেই দেশের অর্থনীতিকে সচল ও সবল রাখতে 

প্রস্তাবনা ও উপসংহারঃ

  • জাতীয় বাজেটে যুব উন্নয়ন ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধি এবং তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা বিশেষ করে অঞ্চল, উপজেলা ও ইউনিয়ন ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা
  • গতানুগতিকের বাইরে গিয়ে বিকল্পধারার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং যুবসমাজকে এধরনের কর্মসংস্থানে উদ্ধুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান
  • গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থার উপর জোর প্রদান করা শিক্ষাব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ ও খেলাধূলার পরিধি বৃদ্ধিকরণ স্কুল পর্যায় থেকে কার্যকর ও ব্যবহারিক পদ্ধতিতে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চায় জোর প্রদান এবং শিক্ষাব্যবস্থায় তা বাধ্যতামুলক করা
  • সাংস্কৃতিক অঙ্গন, ক্রীড়া ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার করার সুযোগ বৃদ্ধি করণ এবং  দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব ক্ষেত্রোন্নয়ন ও যুবসমাজের অংশগ্রহণ উদ্ধুদ্ধ করণ
  • গ্রামীণ পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সুযোগ সৃষ্টি, এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণ

যুবসমাজের উন্নয়নে যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে সরকার সহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে একটি উন্নত যুবসমাজ গঠনে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যার যার অবস্থান থেকে সচল দ্বায়িত্ব পালন অপরিহার্য আমাদের যুব সমাজকে রক্ষা করা আমাদের দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য, তাই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনকে এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার, উন্নয়নসহায়ক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পারিবারিক পর্যায়ে একাত্ত্বতার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে 

Leave a Comment

Scroll to Top