লিখেছেনঃ সামিয়া তাহসীন হক
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পিরিয়ড বা মাসিক এখনও অনেকের কাছে ট্যাবু। ২০১৪ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেইজলিন সার্ভের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪০% মেয়ে পিরিয়ডের দিনগুলোতে গড়ে তিনদিন করে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। এসএনভি বাংলাদেশের রিপোর্ট অনুযায়ী এখনো ৮৯% মহিলা পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন কারণ ডিসপোজেবল স্যানিটারি ন্যাপকিন তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এসব পুরোনো কাপড় ব্যবহার করার ফলে ৭৩% বাংলাদেশী নারী মূত্রনালীর ইনফেকশনসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে।
নিম্নআয়ের নারীরা, যাদের মাসে গড় আয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা, তাদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন রীতিমতো বিলাসদ্রব্য কারণ প্রতি প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম গড়ে ১০০ থেকে ১৬০ টাকা। বেশ কিছু গার্মেন্টসকর্মী এবং বাসাবাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের স্থানীয় ফার্মেসিগুলোতে কোন ধরনের স্যানিটারি প্রোডাক্ট কিনতে পাওয়া যায়না কারণ বেশিরভাগ নারীই সেগুলো কেনার সামর্থ্য রাখেন না। এই পরিস্থিতিই নির্দেশ করে বাংলাদেশ Period Poverty তে ঠিক কতটা নিমজ্জিত।
উপরন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্যানিটারি ন্যাপকিনের আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর ৪০ শতাংশ এবং আমদানিকৃত সকল ন্যাপকিনের উপর ৪৫ শতাংশ পরিপূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাবনা আনা হয়, যেখানে আগে থেকেই স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত সকল ন্যাপকিনের উপর ১৫% ভ্যাট বহাল আছে। স্বাভাবিকভাবেই এই সিদ্ধান্ত সকল মহলে কঠোর সমালোচনার জন্ম দেয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি আয়োজিত হয়। সেখানে বক্তারা বলেন, স্যানিটারি ন্যাপকিন কোন বিলাসদ্রব্য না বরং এটি একটি জীবনরক্ষাকারী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিস যার অনুপস্থিতিতে মাসিক সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা এবং রোগ দেখা দিতে পারে। অথচ এটি তৈরির প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানি পর্যন্ত এটিকে একটি বিলাসদ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন কর বসানো হয়। ফলে এর দাম সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে থাকে। বক্তারা আরো বলেন, শুধুমাত্র বিভিন্ন ভ্যাট ও কর প্রত্যাহারই নয়, এই ধরনের সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর ভর্তুকি প্রদান করা সরকারের দায়িত্ব, যাতে অধিকাংশ নারী স্যানিটারি প্রোডাক্টগুলো কিনতে পারার মাধ্যমে নিরাপদ মাসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারেন।
দেশজুড়ে সাধারণ ভোক্তা, ব্যবসায়ী এবং নারী অধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী এ এইচ এম মুস্তফা কামাল স্যানিটারি পণ্যের কাঁচামালের উপর শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাবনা সংসদে উত্থাপন করেন। এর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড স্যানিটারি ন্যাপকিনের কাঁচামালের উপর পরিপূরক শুল্ক দুই বছরের জন্য প্রত্যাহার করে যার মেয়াদ শেষ হয় ৩০ জুন, ২০২১ এ। কিন্তু তারপরেও স্যানিটারি প্রোডাক্টসমূহের দাম নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত নারীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে থাকে কারণ স্থানীয়ভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন করতে যে ধরনের কাঁচামালের প্রয়োজন হয় সেগুলোর উপর চড়া হারে শুল্ক, নিয়ন্ত্রক শুল্ক, পরিপূরক শুল্ক, অগ্রিম আয়কর এবং নিয়ন্ত্রক কর আগে থেকেই বসানো আছে। এর ফলে, স্থানীয় উৎপাদনকারীদের মতে কাঁচামালের উপর প্রস্তাবিত ভ্যাট প্রত্যাহার স্যানিটারি প্রোডাক্টের বর্তমান মূল্যের ক্ষেত্রে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে না। বরং যদি ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর এবং অন্যান্য অতিরিক্ত করসমূহ বাদ দেয়া হয়, তবেই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসবে এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় স্যানিটারি প্রোডাক্টগুলো।
সামিয়া তাহসীন হক
Samia Tahsin Hoque
Associate, YPF Editorial & Content (Bangla) at Youth Policy Forum.
অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস।