প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা: অবহেলিত সদ্য মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য

লিখেছেন: এম.ডি.মাহিন , কাজী সুমাইয়া সাবা
অলংকরন: মাইশা ফারাহ্
সম্পাদনায় : তাসফিয়া জামান মৌরী
আপনি কি কখনো লক্ষ্য করেছেন যে, প্রসবের পর কিছু নারী অবিশ্বাস্যভাবে বিরক্ত হয়ে ওঠেন? একজন নতুন মায়ের মেজাজ যখন অতিরিক্ত চড়া থাকে বা কোনো কারণ ছাড়াই তিনি চুপ হয়ে যান তখন তা কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়। এটিকে বলা হয় পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (postpartum depression – PPD) বা প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা। আমরা সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খুব বেশি কথা বলি না। এবং যখন একটি নতুন মায়ের মানসিক সুস্থতার কথা আসে, তখন নতুন শিশু এবং তার পাশাপাশি অন্যান্য হাজার হাজার বাস্তব সমস্যাই সেখানে বেশি প্রাধান্য পায়।
প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা (PPD) জনস্বাস্থ্যের একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা যা মায়ের গর্ভাবস্থা-পরবর্তী সুস্থতা এবং নবজাতক শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা (PPD) একটি সাধারণ, ননসাইকোটিক মুড বা মানসিক ব্যাধি যা সাধারণত প্রসবের এক বছরের মধ্যে ( প্রসবোত্তর প্রথম বছর) সদ্য মায়েদের প্রভাবিত করে। একজন নারী প্রসবের পর প্রথম দুই মাসের মধ্যে যেকোন সময় প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা অনুভব করতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে, লক্ষণগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগে তিন থেকে চার মাস ধরে ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে।
মায়েদের মধ্যে PPD এর প্রকোপ বিশ্বজুড়ে যথেষ্ট আকারে পরিবর্তিত হয়, ০.৫% থেকে ৬০.৮% পর্যন্ত । উন্নয়নশীল দেশের নারীদের উন্নত দেশের নারীদের তুলনায় PPD এর হার বেশি। এশীয় দেশগুলোতে প্রসবোত্তর নারীদের মধ্যে বিষণ্নতার প্রবণতা ৩.৫–৬৩.৩%। বাংলাদেশে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে PPD এর প্রবণতা ১৮% থেকে ৩৫% পর্যন্ত পাওয়া গেছে এবং শহুরে দরিদ্র মায়েদের মধ্যে PPD এর প্রবণতা ১২.৩% থেকে ২৮.৫%। শহরে বস্তিতে প্রসবোত্তর বিষণ্নতা বেশি দেখা যায়। শিশুর জন্মের পর প্রথম ১২ মাসের মধ্যে মায়ের PPD-তে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে ৩৯.৪%। সন্তান প্রসবের পরে চাকরি সংক্রান্ত সম্পৃক্ততা, গর্ভাবস্থার কারণে চাকরি হারানো, গর্ভপাতের ইতিহাস বা শিশুর মৃত্যুর ইতিহাস, অনিচ্ছাকৃত গর্ভাবস্থা, প্রসবের ব্যয় পরিচালনা করতে ধার, সম্পদ বিক্রি বা বন্ধক, গর্ভাবস্থায় হতাশাজনক লক্ষণ এবং অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতা ইত্যাদিকে PPD এর ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই বিষণ্নতার কোন নির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা যায় না, তবে শারীরিক এবং মানসিক সমস্যাগুলো কখনও কখনও ভূমিকা পালন করে। শারীরিক কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোনের লক্ষণীয় হ্রাস যা একজন মাকে ক্লান্ত, অলস এবং বিষণ্ণ করে তোলে। একজন মা তার ঘুম থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে
শারীরিকভাবে ক্লান্ত হতে পারেন যা পরবর্তীতে মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে; যেমন নিজের নবজাতককে দেখাশোনা করার জন্য উৎসাহিত বোধ করা না করা এবং অনুভব করা যে তিনি নিজের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন — যা বিষণ্নতার দিকেও যেতে পারে। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
● হতাশাগ্রস্ত মেজাজ এবং গুরুতর মেজাজ পরিবর্তন।
● পরিবার এবং বন্ধুদের এড়িয়ে চলা।
● ভালো মা হওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাব।
● ঘুম এবং খাওয়ার ধরণ পরিবর্তন।
● শিশুর ক্ষতি করার চিন্তা।
● আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টার চিন্তা।
● যৌন সম্পর্কের আকাঙ্ক্ষা হ্রাস।
● প্যারানয়া এবং সন্দেহ।
● চরম উত্তেজনা বা খুবই শান্ত মেজাজ।
● গুরুতর বিভ্রান্তি।
প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা মায়ের হলেও এটি শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা শিশুকে নিম্নমানের খাওয়ানোর অভ্যাসের দিকে পরিচালিত করে, ফলে শিশুর পুষ্টিহীনতা বাড়ে এবং শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়। PPD-এর প্রভাব শুধুমাত্র শারীরিক উপসর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আক্রান্ত মায়েদের শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করতে পারে। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা মায়ের এবং শিশুর মধ্যে নিম্নমাত্রার যোগাযোগ এবং বন্ধনের দিকে নিয়ে যায়, যা শিশুর অপ্রতুল সামাজিক, আবেগীয় এবং জ্ঞানগত বিকাশের দিকে নিয়ে যায়। গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে বারবার বিষণ্নতা পরবর্তীতে অতিরিক্ত দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের দিকে নিয়ে যায়। উপরন্তু, PPD পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
প্রসবোত্তর সাইকোসিসের অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন, কারণ এটি খুব দ্রুত খারাপ হতে পারে যার ফলে মা তার শিশুর বা নিজের ক্ষতি করতে পারেন। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা এবং সাইকোসিস একটি মেডিক্যাল সমস্যা। অন্য যেকোনো মেডিক্যাল সমস্যার মতো যথাযথ সেবা, চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় যত্ন এবং সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ একজন মাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করে।
মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে বিদ্যমান মাতৃ-স্বাস্থ্যসেবার সাথে একীভূত করা উচিত। বাংলাদেশের শহুরে বস্তিতে কার্যকর, সাশ্রয়ী এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত PPD চিকিৎসা পরিচালনা এবং প্রতিরোধমূলক হস্তক্ষেপ উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা এবং আমাদের করণীয় কি হতে পারে এ নিয়ে ওয়াইপিএফের আর্টিকেল সিরিজের তৃতীয় এবং সর্বশেষ আর্টিকেল এটি।
প্রথম আর্টিকেলটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 
দ্বিতীয় আর্টিকেলটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
Scroll to Top