বুক রিভিউঃ আপনাকে বলছি স্যার- বারবিয়ানা স্কুল থেকে

গ্রন্থ পর্যালোচক: সুবাহ বিনতে আহসান

আমাদের স্কুলের সেসব গোবেচারা, অসহায় সহপাঠীদের কথা মনে পড়ে? পরীক্ষায় যারা বারবার ফেল করেছে, ক্লাসে যারা কখনোই পড়া পারেনি? আমাদের শিক্ষকরা “ফেল করা, পড়া না পারা” ছাত্রদের জন্য একটা উপাধি আলাদা করে রেখেছিলেন- “গাধা”। এই উপাধির বোঝা ঘাড়ে নিয়ে দিন দিন সেসব ছাত্ররা ন্যুব্জ হয়েছে সংকোচে, তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে গেছে বরাবরের মত। অথচ এসব “গাধা”রা যেন শিখতে পারে সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আদতে কার ছিলো?! উপাধির বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে যিনি তার ছাত্রের শেখার ইচ্ছেকে মেরে ফেললেন, তিনি কি তার দায়িত্ব পালন করেছেন আদৌ?! এসব প্রশ্নগুলো আমাদের মনেও কোনো না কোনো সময় এসেছে, কিন্তু আমরা এগুলোকে মনের ভুল ভেবে বাদ দিয়েছি। বাদ দেয়নি বারবিয়ানা স্কুলের ছাত্ররা। স্কুল, শিক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থার এই আজব কান্ড-কারখানাকে ময়নাতদন্ত করে তারা লিখেছে এই বই।

অদ্ভুতুড়ে বারবিয়ানা স্কুল

“আপনাকে বলছি স্যার” বইটি আসলে একটি খোলা চিঠি। এই বইয়ের লেখকবৃন্দ অর্থাৎ বারবিয়ানা স্কুলের আটজন ছাত্র সম্মিলিতভাবে এই বইয়ের “আমি” আর “আপনি” হচ্ছে বিশ্বের সকল শিক্ষক। এই আটজন লেখকের লেখা বইটিতে তাদের যুক্তি-তর্কের আধার বারবিয়ানা স্কুলে তাদের শিখন-শিক্ষণের অভিজ্ঞতা। ইতালির মুজেল্লো অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রাম বারবিয়ানা, সেখানেই ১৯৫৪ সালে ফাদার দন লোরেনজো মিলানি তাঁর বৈপ্লবিক ও প্রথাবিরুদ্ধ শিক্ষাচিন্তার আলোকে গড়ে তোলেন বারবিয়ানা স্কুল। সে স্কুল আমার আপনার চেনা কোনো স্কুল নয়। রোজ সেখানে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়া হতো সংবাদপত্র, চলতো খবর নিয়ে আলাপ-আলোচনা। পড়া হতো আইনি দন্ডবিধি আর সংবিধান, তারপর সেই নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক। এখানে ছাত্ররা বিদেশি ভাষা শিখতো রেকর্ড বাজিয়ে, ঠিক যেভাবে আমরা মাতৃভাষা শিখি। শিক্ষক কারা ? ছাত্রদের মধ্যেই যারা বয়সে একটু বড়, তারাই ছোটদের পড়াতো। ভেবে দেখুন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দরিদ্র ঘরের স্কুলে-খেদানো ছাত্ররাই পরষ্পরকে পড়াচ্ছে, কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে, না?! 

বইয়ের রকমসকম

বইটির শুরুতেই চিঠির প্রাপককে আন্তরিক সম্বোধন লেখকদের “প্রিয় স্যার”। এখানে নেই জবাবদিহিতা চেয়ে কোনো চোখরাঙানি, বরং এই আন্তরিকতার ছাপ পাওয়া যাবে গোটা বই জুড়েই। ঔদ্ধত্য নয়, অনুসন্ধিৎসা থেকেই বারবিয়ানার ছাত্ররা প্রশ্ন তুলেছে সেদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে, সেখানকার স্কুলে পড়ানো অদরকারি, বাস্তববিবর্জিত পাঠ্যক্রম আর তার হাস্যকর বাস্তবায়ন নিয়ে। বলিষ্ঠ আওয়াজ তুলেছে পরীক্ষা আর পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বিপক্ষে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, যে শিক্ষার হওয়ার কথা ছিলো সকলের জন্য মুক্তির মশাল, তাকেই কীভাবে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যবহার করা হচ্ছে নিপীড়িতকে দাবিয়ে রাখার, শোষণ করার হাতিয়ার হিসেবে। খোলা চিঠিতে এসব ব্যাপারে বারবিয়ানার ছাত্ররা প্রশ্ন-পরামর্শ রেখে গেছে বিশ্বের সকল শিক্ষকের জন্য। পাশাপাশি তারা এই আশাও ব্যক্ত করে গেছে একদিন তাদের প্রত্যাশিত প্রত্যুত্তর আসবেই, তারই সাথে আসবে মুক্তির দিন।

যা কিছু ভালো-মন্দ

বইটির বিষয়বস্তু তো আগেই বলেছি। বুঝতেই পারছেন এসবই আমাদের চেনা বিষয়, ক্ষেত্রবিশেষে আমরাও এসব বঞ্চনা-প্রবঞ্চনা শিকার। তাই বইটি ইতালির প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও জীবনের সাথে সংশ্লিষ্টতা পেতে কোনো অসুবিধা হবে না পাঠকের। পাশাপাশি রয়েছে মূল লেখক এবং ইংরেজি অনুবাদকের পর্যাপ্ত ফুটনোট যা বিভিন্ন শব্দ কিংবা প্রসঙ্গের অস্পষ্টতাগুলোতে আলোকপাত করে। বাংলায় অনুবাদ করেছেন যিনি, সেই সলিল বিশ্বাস দীর্ঘদিন ভারতের ননফরমাল এজুকেশন বা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাধারার তৃণমূল পর্যায়ের সাথে জড়িত ছিলেন। বাংলা অনুবাদে যেমন তিনি অপ্রাসঙ্গিক, একঘেয়ে ও অপ্রয়োজনীয় কিছু পরিসংখ্যান বাদ দেয়ার স্বাধীনতা নিয়েছেন, তেমনি নিজের ফুটনোটে জুড়ে দিয়েছেন প্রাসঙ্গিক কিছু ভারতীয় সমীক্ষা ও দৃষ্টান্ত। এতে করে উপমহাদেশের বাংলাভাষাভাষী পাঠকদের জন্য বইটি হয়ে উঠেছে আরো জীবনঘনিষ্ঠ। তবে আগেই বলেছি বইটি একটি খোলাচিঠি; কোনো পাঠক যদি এতে গতানুগতিক গবেষণাগ্রন্থের মত নির্লিপ্ততা কিংবা বিষয়সূচীর কোনো নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে বিন্যাস আশা করেন, তাহলে আশাহত হবেন।

শেষকথা

বারবিয়ানা স্কুল প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলো “অশিক্ষিত” ও নিপীড়িত মানুষদের সার্বভৌম ব্যক্তিত্বে পরিণত করার প্রয়াস যেন সেসব মানুষেরা নিজেদের মনের চিন্তা প্রকাশ করতে পারে এবং সেই চিন্তার সমর্থনে বিতর্ক চালাতে পারে। আর এই মূঢ়তা আর নৈ:শব্দের সংস্কৃতির মূলে আঘাত হানতেই লেখা এই বই। আমার চোখে স্কুল অব বারবিয়ানা আমার পাঠ্যবইয়ে পড়া স্বপ্নের “জ্ঞানীয় সমাজ”; আর চেনা পৃথিবীর অচেনা বৈষম্যকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে অন্তরের অন্ত:স্থলে আলোড়ন জাগানোর মত বই  ” আপনাকে বলছি স্যার: বারবিয়ানা স্কুল থেকে” ।

(এই বিভাগের লেখা ও মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত মতামতের সাথে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের মতামতের সামঞ্জস্য নাও থাকতে পারে। আমাদের সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করা যেকোন ধারণা ও লেখার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।)

Leave a Comment

Scroll to Top