সত্যজিৎ রায়ের তারিণীখুড়োকে মনে পড়ে? নানারকমের অদ্ভুতুড়ে, ব্যাখ্যাতীত রহস্যময় অভিজ্ঞতায় যেই বয়োজ্যেষ্ঠ্য ভদ্রলোকের ঝুলি একদম পরিপূর্ণ! তারিণীখুড়ো তার ভ্রাতুষ্পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রী কচিকাচাদের আসর জমাতেন সেইসব অতিপ্রাকৃতিক অলৌকিক গল্প দিয়ে। “যে গল্পের শেষ নেই” গ্রন্থটিও দেবীপ্রসাদ লিখেছেন এই কচিকাচাদের আসর জমানোর মেজাজে। তবে একটা ফারাক আছেই। তারিণীখুড়োর আসর জমতো নানাস্বাদের রহস্যের গল্পে, আর দেবীপ্রসাদ আসর জমিয়েছেন পৃথিবী আর মানুষের গল্প দিয়ে।
এক কথায় বলে দিলে বইয়ের মূল বক্তব্য স্পষ্ট হচ্ছে না। তাই একটু ভেঙেচুরেই বলি। মূল বইটিতে একজন কথক এবং একজন শ্রোতাকে দেখা যায়। কথকটি অবশ্যই লেখক নিজে এবং শ্রোতাটি তার ছোট্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী। সেই মেয়েটির আবদারেই কথক বলতে শুরু করেন এমন একটি গল্প যার শেষ নেই, অথচ কোথাও কোনোরকম ফাঁকিও থাকবে না। এমন গল্প একটিই আছে, তা হলো খোদ এই পৃথিবীর গল্প- কীভাবে পৃথিবী তৈরি হলো, কীভাবেই বা সে আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়ালো, আর এই অগ্রযাত্রায় মানুষের অবস্থানই বা কোথায়, মোটকথা এসব নিয়েই দেবীপ্রসাদের আসর জমানো গল্প এগিয়ে চলে।
দেবীপ্রসাদ এই বইতে সহজবোধ্য করে মানুষের ইতিহাস বলার একটি প্রয়াস নেন। সেই ইতিহাসের পটভূমি একেবারে সৃষ্টির আদিমুহূর্ত। বইটির যদি দুটি অংশ চিন্তা করি, তাহলে এর প্রথমার্ধে লেখক মূলত নজর দিয়েছেন পৃথিবী ও প্রাণের সৃষ্টি এবং মানুষের বিবর্তন ও আদিম মানবসমাজের দিকে। দ্বিতীয়ার্ধে লেখক বলেছেন মানবসৃষ্ট বিভিন্ন সভ্যতা এবং আজকের মানবসমাজের কথা। একদিকে যেমন লেখক আদিম মানুষের অনিশ্চিত জীবনযাত্রার পাশাপাশি তুলে ধরেছেন তাদের একতার মহিমা, তেমনি মানবসৃষ্ট ঝাঁ-চকচকে, চোখ ধাঁধাঁনো সভ্যতার উল্টোদিকেই তিনি তুলে ধরেছেন মানুষের সেই সুমহান ঐক্য ধ্বংস আর সম্পদের অসম বন্টনের জোরে তৈরি হওয়া এক অলীক শ্রেণিকরণের ভিত্তিতে উন্নয়নের যাঁতাকলে কিছু মানুষের পিষ্ট হওয়ার করুণ আখ্যান। একদিকে যেমন এই বইটি মানুষের অগ্রযাত্রার কথা তুলে ধরেছে, তেমনি সেই অগ্রযাত্রার পিছনে লুকিয়ে রাখা শাসন-শোষণের কথা বলতেও পিছপা হয়নি। আর এই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে এবং ধরে রাখতে যে ঠিক কীভাবে যুগে যুগে ধর্ম আর সংস্কারকে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়টিও লেখক খোলাসা করে বলেছেন এই গ্রন্থে। ক্রীতদাসপ্রথা, সামন্তবাদ, শিল্পবিপ্লব, সবশেষে ধনতন্ত্র – এই সবকিছু পৃথিবী ও মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থোদ্ধারের জন্য কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে দুর্দশা ও দুর্ভোগের অমানিশা ছেয়ে থাকে , বইটিতে সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়।
বইটি অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখা- লেখার ভঙ্গি থেকে উদাহরণ দেয়ার ধরণ পর্যন্ত সবকিছুই এমন যে যেকোনো বয়সের পাঠকই সহজে বুঝতে পারবে। পাশাপাশি লেখার প্রাঞ্জলতার কারণে কারোরই একঘেয়ে লাগবে না, বরং এক নতুন কৌতুহলের দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে চেনার আগ্রহ তৈরি হবে। তবে সহজে সংক্ষেপে ইতিহাস বোঝানোর কারণে মোটা দাগে খুবই জেনারালইজডভাবে ইতিহাসটা বলে যেতে হয়েছে- ছোটদেরকে গল্প শোনানোর ক্ষেত্রে যেমন করা হয়, তেমন। মানুষের মেহনতের অবমূল্যায়নকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বইতে। উদাহরণ দেয়ার ক্ষেত্রেই ইতিহাসের বিভিন্ন বড় বড় ঘটনা যেমন বিভিন্ন যুদ্ধ বা বিপ্লবের উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু কোনো বিস্তারিত বিবরণ বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
লেখকের লেখার ভঙ্গিতে অনেকেরই বইটিকে শিশুতোষ গ্রন্থ মনে হতে পারে। বইটি অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখা সত্য, কিন্তু এটি কেবল শিশু-কিশোরদের জন্যই নয়। সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহী যে কারোর জন্য বইটি হতে পারে ইতিহাসের প্রথমপাঠ।
পর্যালোচকঃ সুবাহ বিনতে আহসান
*Any views expressed in this review are that of the author’s only. This is not necessarily a reflection of the viewpoint of YPF. We welcome the sharing of all ideas as long as they follow our guidelines.