নিদ্রা বুনারাজি এবং সুভদ্রা বুনারাজি – একাত্তর থেকে একুশে : সুবর্ণ উচ্চারণ

নিদ্রা বুনারাজি আর সুভদ্রা বুনারাজি, তারা ছিলো দুই বোন। দুজনেই কাজ করতো মৌলভীবাজারের একটা সুন্দর, ছিমছাম চা বাগানে। আর সময়টা ১৯৭১ সাল। বেশ সুন্দরী ছিলো নিদ্রা, বয়স তখন সবে ষোলো কি সতেরো! বিয়েও ঠিক হয়ে গিয়েছিল তার। আর ছোট বোন সুভদ্রা ছিল নিদ্রার বছর খানেকের ছোট। তাদের বাড়িতে একটা পাঁচ মাস বয়সী ছোট ভাই ছিল। নিজেরা রোজগার করে, ছোট ভাইটিকে নিয়ে হেসে খেলে আনন্দেই দিন কাটছিলো এই আদিবাসী পরিবারটির। তারপর হঠাৎ করেই বদলে গেল তাদের জীবন। হাসি আনন্দের বদলে জীবন ভরে উঠলো ভয় আর আতঙ্কে।
নিদ্রার বাবা কদিন ধরেই দু’বোনকে বাগানের কাজে যেতে দিচ্ছিলেন না। কেন যেতে দিচ্ছেন না তাও সঠিক বলতে চাননা। কিন্তু এভাবেই বা কদিন চলে? পেটের দায় তো আছেই৷ কাজে যেতে শুরু করলো তারা। তখন জানতে পারল পাকিস্তানি সৈন্যরা বাগানের মেয়েদের নির্যাতন করছে। আর পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করছে। তারপর থেকে নিদ্রা আর সুভদ্রা লুকিয়ে একবেলা কাজে যেত। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি!
একদিন রাতে ঐ নরপশুদের থাবা পড়লো নিদ্রাদের ছোট্ট ঘরে। দরজা ভেঙে ঢুকলো পঞ্চাশোর্ধ তিনজন মানুষরূপী পশু। শুরু হলো মারধর। পাঁচ মাসের শিশুটির দিকে হাত বাড়ালে নিদ্রা ছুটে গিয়েছিল তাকে বাঁচাতে। এতে রাগান্বিত হয়ে সেই পশুরা সেই শিশুটির গলায় পা দিয়ে পিষে ফেলল। তাকে ছুঁড়ে ফেলল বাইরে। ততক্ষণে নিদ্রা বা তাদের কারোরই আর উঠে দাঁড়াবার শক্তি ছিলনা।
এরপর তারা হাত বাড়ালো নিদ্রার দিকে। সেদিন বারবার ধর্ষিত হচ্ছিলো নিদ্রা। তা সহ্য করতে না পেরে সুভদ্রা দিদির কাছে ছুটে আসতে চেয়েছিল। তখন ধর্ষণের শিকার হয় সুভদ্রাও। তারপর তাদেরকে দুটি ভিন্ন মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তারা ধর্ষিত হতো। সেই যন্ত্রণার দাগ তারা আমৃত্যু বয়ে বেড়াবে।
হাজারো কান্না, আর্তচিৎকারে ভারী পরিবেশে অর্ধমৃত হয়ে পড়ে নিদ্রা বুনারাজি। শত অনুরোধেও মন গলেনি পশুদের, তারা নির্যাতন বন্ধ করেনি। ধর্ষণের আঘাতে তার শরীরে পঁচন ধরে। একসময় মিলিটারিরা তাকে তার বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ফেলে রেখে গিয়েছিল। তার পাগলপ্রায় মা খুঁজে পায় তাকে। ততদিনে তার বাবা মৃত। সুভদ্রার খোঁজ মেলেনি তখনও।
সুভদ্রা তখনও ক্যাম্পে। প্রতিদিন শতবার করে ধর্ষিত হয়ে সে তখন নিজের মৃত্যু কামনা করছে। তার জরায়ুতেও পঁচন ধরেছে। তবু ধর্ষণ থামছে না। একদিন ধর্ষণের সময় জরায়ু থেকে গলগল করে রক্তপাত শুরু হলো৷ ধর্ষণে ব্যাঘাত ঘটায় সেদিন সেই মিলিটারি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে দিয়েছিল সুভদ্রার বাঁ দিকের স্তন। এই অবস্থায় তাকে আর ধর্ষণ করা সম্ভব হতোনা, তাই সুভদ্রা ফিরতে পেরেছিল নিজের বাড়িতে।
ক্ষত- বিক্ষত শরীর আর মৃত মন নিয়েও এই দুই বোন বেঁচে থাকলো। স্বাধীন হলো দেশ। বীরাঙ্গনার সম্মান পেল৷ কিন্তু সমাজ তাদের মেনে নিতে পারলো না৷ বিয়ের প্রস্তাব আসলেও তাঁরা বীরাঙ্গনা জানার পর বিয়ে ভেঙে যেত। তাঁরা লোকদের কাছে বেশ্যাবৃত্তির জন্য কুপ্রস্তাব পেতেন। ভাবা যায়! যাদের সম্মান- সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো, তাঁরাই সমাজে অস্পৃশ্য হয়ে উঠল।
এরপর চা বাগানের বড় সাহবের উদ্যোগে সুভদ্রার বিয়ে হয়। বলা বাহুল্য,বরের বাড়িতে তাঁর বীরাঙ্গনা পরিচয় গোপন করা হয়েছিল। বোনদের বিয়ে আর জীবন গোছাতে গিয়ে নিদ্রা আর বিয়েই করলেন না। একাই কাটিয়ে দিলেন জীবন।
এমন অনেক আদিবাসী বীরাঙ্গনা আছেন৷ তাঁদের নাম পরিচয় আমরা জানিনা। দেশের জন্য সর্বস্ব খুইয়ে, স্বাধীন দেশেও মর্মান্তিক জীবন যাপন করে গেছেন তাঁরা। সমাজের কাছে আমৃত্যু পাননি কোনো সম্মান। এই বুনারাজি বোনদ্বয়ের মত প্রত্যেক বীরাঙ্গনা নারীকে জানাই সম্মান। স্যালুট জানাই এই মহীয়সী নারীদের প্রতি!
লেখা: আজিজুন নাহার লিমা
ক্রিয়েটিভ: ওয়াহিব অমিও
তথ্যসূত্র:
১. ১৯৭১ সম্ভ্রম হারানো নারীদের করুণ কাহিনী- সুরমা জাহিদ।
২. আদিবাসী বীরাঙ্গনা – ডানা বড়ুয়া

Leave a Comment

Scroll to Top