আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে আগে-পরে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, তাহলে এই বইটির বিশেষত্ব কী? এই প্রশ্নের উত্তরে লেখকের কথাই ধার করতে হয় – ” স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রসঙ্গে বলতে বা লিখতে গেলে জনগণের ভূমিকা সম্বন্ধে সচরাচর যা বলা হয়, তা হলো- বাংলাদেশের ছাত্র, কৃষক, জনতা, পেশাজীবী শ্রেণীগোত্র নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপর আলোচনার চরিত্র ক্রমাগত সীমিত হয়ে আসে অল্প কিছু রাজনৈতিক লেখা, কিছু সামরিক ব্যক্তিত্ব, কিছু বুদ্ধিজীবী এবং আরও অল্প কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির মধ্যে। সাড়ে সাত কোটি জনগণের জন্য বরাদ্দ রইল ওই একটি লাইন, কখনোবা একটি প্যারাগ্রাফ বড়জোর।” আদতেই তাই, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন কোণে, সমরাঙ্গন কিংবা গুপ্তচরবৃত্তিতে যেসব অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিলো, কালের ব্যবধানে গুরুত্বের অভাবে হারিয়ে গেছে তার অনেকটাই । মুক্তিযুদ্ধের অধিকাংশ যোদ্ধারা যেই সাড়ে সাত কোটি আমজনতার অংশ, তাদেরকেই গণযোদ্ধা নাম দিয়ে তাদের বীরত্বের গল্পগুলোকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেই লেখকের এই প্রয়াস।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন,অধিকাংশ ঘটনাই লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যারা ইতিহাসবিদদের ফিল্ট্রেশনে বাদ পড়ে গিয়েছিলো, তাদের গল্পগুলোই লেখক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখেছিলেন। সেসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলোরই সংকলন এই বই। বইটির মোট ১১টি লেখায় উঠে এসেছে একাত্তরের জনযুদ্ধের গণযোদ্ধাদের গল্প। এর মধ্যে কোনো গল্প রণাঙ্গনের, কোনো গল্প গেরিলা আক্রমণের। কোনোটি হয়তোবা বিজয়োল্লাস জাগাবে পাঠকের মনে, কোনোটি আবার ভরিয়ে দেবে তীব্র বিষন্নতায়। বইটিতে যেমন একদিকে উঠে এসেছে শ্রেণি-গোত্র-পেশা নির্বিশেষে মানুষের অসীম সাহসিকতা এবং নি:স্বার্থ আত্মবলিদানের আখ্যান , তেমনি উঠে এসেছে হানাদার ও তাদের দোসরদের নির্মমতার গল্পও। কিছু ঘটনা যেমন একাত্তরের, তেমনি স্বাধীনতা-উত্তরকালেরও কিছু ঘটনা আছে। যেমন এদেশি মানুষদের সংগ্রামের কথা উঠে এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে বিদেশি বন্ধুদের কথাও। মোটকথা, স্থান-কাল-পাত্র এমনকি বিষয়বস্তুভেদেও এসব গণযোদ্ধাদের প্রত্যেকটি গল্পই অনন্য।
এই বইটিতে লেখক তার সহযোদ্ধাদের কিংবা ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করেননি। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশে একাত্তরের গণযোদ্ধাদের অবস্থান এবং পরিস্থিতি নিয়েও সৎ থেকেছেন। তাই তিনি অবলীলাক্রমেই বলতে পেরেছেন তার চোরাকারবারি সহযোদ্ধাদের কথা যাদের স্বাধীনতার পরও আবার আগের পেশাতেই ফিরতে হয়েছে। পাশাপাশি কিছু যুদ্ধাপরাধীদের পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার ঘটনাও তিনি লিখেছেন। যুদ্ধের গল্প বলতে গেলেই প্রায়ই বিভিন্ন রণকৌশল চলে আসে, লেখক সেগুলোকেও যথাসম্ভব সহজভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন এবং প্রয়োজনমত ফুটনোট ব্যবহার করেছেন। বইয়ে উল্লিখিত ঘটনাগুলো বেশ বৈচিত্র্যময় হওয়ায় পড়ার সময়ে একঘেয়েমি আসার সুযোগ নেই। আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেসব গল্পের অধিকাংশই এখনো রয়ে গেছে অলক্ষ্যে। অবশ্যই এই বইয়ে সব ঘটনা উঠে আসেনি কিংবা সব ঘটনাকে তুলে আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার ভিত্তিতে বইটিকে বিচার করলে নি:সন্দেহে ভুল করা হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোনো রূপকথার চাইতে কোনো অংশে কম নয়। সেই রূপকথার সব নায়ক-নায়িকা, পাত্র-পাত্রী সেনাসদস্য, সচেতন ছাত্র কিংবা বুদ্ধিজীবি নন, বরং অধিকাংশই এদেশের মাঠে-ঘাটে খেটে খাওয়া মানুষ। এরা শুধু জীবন বাজি রেখে যুদ্ধই করেছে, কিন্তু কখনো নিজেদের কথা বলার কিংবা লেখার সুযোগ পায়নি। তাদের প্রায়-বিস্মৃত এবং অব্যক্ত গল্পগুলো জানতে হলে পড়তে হবে “জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা” ।
(এই বিভাগের লেখা ও মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত মতামতের সাথে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের মতামতের সামঞ্জস্য নাও থাকতে পারে। আমাদের
সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করা যেকোন ধারণা ও লেখার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।)
Author : সুবাহ বিনতে আহসান
Authors Bio : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনিষ্টিটিউট,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
#YPFLiterature #YPFBookReview