বুক রিভিউঃ প্লেটোর রিপাবলিক

পর্যালোচক: Hosnain R. Sunny

জ্ঞান রাজ্যের ইতিহাসে কোন বই যদি পৃথিবীর সমাজ পরিবর্তন করতে পারে তবে নিঃসন্দেহাতীত ভাবে সবার প্রথমে থাকবে প্লেটোর ‘’রিপাবলিক’’। প্লেটোর বিরুদ্ধে সমালোচনা যাই থাকুক না কেন, একথা অনস্বীকার্য যে, প্লেটোর সংলাপ বিশ্বে জ্ঞানভাণ্ডারের এক অমূল্য সম্পদ এবং তাঁর সমস্ত সংলাপের মধ্যে রিপাবলিক হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। ‘’রিপাবলিক’’ একটি সামগ্রিক তত্ত্বগ্রন্থ। বলা চলে এই গ্রন্থে প্লেটো একটি গ্রন্থের আকার লাভ করেছেন। এই সংলাপে আমরা যেমন অধিবিদ্যা (দর্শন), ধর্মতত্ত্ব, নীতিতত্ত্ব, তাঁর মনোবিদ্যার ধারনা পাই ঠিক তেমনি পাই তাঁর শিক্ষা, রাষ্ট্রনীতি এবং শিল্পতত্ত্বেরও। এই গ্রন্থে আমরা যে সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে দেখি প্লেটো এবং সক্রেটিসকে; সেই সব সমস্যা আজ ২৫০০ বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সমান ভাবে বিদ্যমান। আর এখানেই প্লেটোর সার্থকতা। এই কারণেই রিপাবলিক নিয়ে আলোচনা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান।

এই সংলাপের মধ্যে আজ থেকে ২৫০০ বছর আগেও আধুনিকতার স্পষ্ট আভাস প্লেটোর সাম্যবাদ, সমাজতত্ত্ব, নারীতত্ত্ব এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সহ সমসাময়িক অনেক গুলো বিষয় আমরা অবলোকন করি। এখানে নীৎসের নীতি দর্শন যেমন স্থান পেয়েছে ঠিক তেমনি স্থান পেয়েছে রুশোর শিক্ষানীতির এবং তাঁর প্রাকৃতিক রাজ্যের উত্তমত্তার চিন্তা। বাদ যায় নি, বারগসের জীবনশক্তির এমনকি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষার। এক কথায়ঃ রিপাবলিক এ কি নেই? সবকিছুই এতে বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থটিকে দর্শন না বলে যদি আমরা সাহিত্য চিন্তা করি তাহলে আমাদের বলতে হবে, সাহিত্যে রচনায় এ যেন, বিদ্দ্যজ্জনের ভোজসভায় অতিথিপরায়ণ উদার হৃদয় প্লেটোর অকৃপণ মূল্যায়ন।

দর্শন এবং রাজনীতির ইতিহাসে প্লেটোর ‘’রিপাবলিক’’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যার লেখক প্লেটো ছিলেন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের ছাত্র। এই সংলাপটির মুল উপজীব্য বিষয় হচ্ছে, ন্যায় এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক রূপ অন্বেষণ। আমি রিপাবলিক এর সারমর্ম করতে গিয়ে গ্রন্থটিকে কয়েকটি অংশে বিভক্ত করেছি।

যে তথ্য সবার বুঝতে হবে

প্লেটো শক্তিশালী সাহিত্যিক ছিলেন। কিন্তু প্লেটো সাহিত্য সৃষ্টির জন্য তাঁর গ্রন্থরাজি রচনা করেননি। একথা সত্য, সংলাপ বা নাটক আকারে তিনি তাঁর গ্রন্থসমুহ রচনা করেছেন। কিন্তু প্লেটো নাট্যকার ছিলেন না। প্লেটো সংলাপের মাধ্যমে জগৎ, জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর দর্শন এবং অভিমত সমূহ ব্যক্ত করেছেন। ‘’রিপাবলিক’’  গ্রন্থকে প্রাচীনকালে রিপাবলিক নামে আখ্যায়িত করা হত না। এর দ্বিতীয় নাম ছিলঃ ‘’ন্যায় সম্পর্কে আলোচনা’’। রিপাবলিক বলতে আধুনিককালে একটি বিশেষ ধরনের শাসনব্যবস্থার কথা মনে আসেঃ ‘’গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা’’। কিন্তু গ্রীক ভাষায় রিপাবলিক শব্দের অর্থ অনেক ব্যাপক ছিল। রিপাবলিক বলতে সাধারণভাবে শাসনতন্ত্র, রাষ্ট্র বা সমাজকে বোঝাত। প্লেটো সাধারণভাবে রাষ্ট্র এবং সমাজের সমস্যাসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছেন। হয়তো সে কারণেই ‘’রিপাবলিক’’ নামটি অধিক ব্যবহৃত হয়েছে এবং বর্তমানে এই নামেই সর্বভাষায় পরিচিত।

মুল উপজীব্য

রিপাবলিক একটি নাটক। ঘটনার নয়, যুক্তির নাটক। গ্রন্থের মধ্যে যুক্তি হচ্ছে চরিত্র। সক্রেটিসকে বলা চলে যুক্তির কথক, যুক্তির উপস্থাপক। এই নাটকের শুরু কোন নাটকীয় বিস্ফোরণ, দৃশ্য-উন্মোচন দিয়ে নয়। সক্রেটিস তাঁর সহচর গ্লুকনকে সঙ্গে নিয়ে পাইরিউস বন্দরের অশ্বদৌড় দেখে এথেন্সে প্রত্যাবর্তন করছেন। এমন সময় সিফালাস পুত্র পলিমারকাস তাঁদের প্রত্যাবর্তনের পথরোধ করে তাঁদের গৃহে রাত্রি যাপনের জন্য অনুরোধ করেন। তাঁর নিরতিশয় অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না সক্রেটিস এবং গ্লুকন। তাঁরা সিফালসের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন। সেই গৃহে বৃদ্ধ সিফালাসের সঙ্গে আলোচনাক্রমে বার্ধক্যের লাভ-লোকসানের প্রশ্ন উঠে। এই সমস্যার আলোচনা থেকে একটা পর্যায়ে যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যায় ‘’ন্যায়’’ কি? এমনি অ-নাটকীয় ভাবে রিপাবলিকের উন্মোচন ঘটে। এমন বৈশিষ্ট্যহীন সূচনা যেন আমাদের এই কথাটিকেই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জীবনের সমস্যা এবং তা নিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের যুক্তিভিত্তিক আলোচনা কোন নাটকীয় আকস্মিক ঘটনা নয়। এভাবেই যুক্তির পর যুক্তি বসিয়ে  আলোচনা অগ্রসরমান হতে থাকে। কিন্তু এই আলোচনা সূত্র, সঙ্গতি এবং পরিকল্পনা শুন্য নয়। কথার টানে কথা আসছে, যুক্তির টানে যুক্তি আসছে। ব্যাপারটি এমনও নয়। আসলে একটি মুল বিষয়বস্তুকে সামনে রেখেই যুক্তির পড় যুক্তি বসিয়ে সমস্যার পর সমস্যা উথাপিত হয়েছে। আমরা এই রিপাবলিক গ্রন্থ থেকে মূলত তিনটি (৩) বিষয় যদি পরিষ্কার বুঝতে পারি তাহলে পুরো বইটির মর্মার্থ হয়ে যাবে আশা করি।

১। ন্যায় কি এবং ন্যায়ের সম্পর্কে সম্যক ধারনা পেতে চাইলে আমাদের অবশ্যয় একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি (ছোট পরিসরে) এবং একটি শহরের (বড় পরিসরে) মধ্যে আলোকপাত করতে হবে।

২। এই স্বতন্ত্র ব্যক্তি এবং শহর আবার তিনটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদানে গঠিত হবে।

৩। প্লেটোর ইউটোপিয়ার অবতরণ

ন্যায় এবং ন্যায় সম্পর্কে সম্যক ধারনা

সংলাপের শুরুতেই সক্রেটিস এবং তাঁর সঙ্গীরা মিলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে ন্যায় এর সংজ্ঞা বুঝতে চেষ্টা করে। সংলাপ যতো সামনের দিকে আগাতে থাকে আমরা দেখতে থাকি ন্যায় এর সংজ্ঞা অনেকগুলো লুপহোল ছাড়া বের করা সহজ কাজ নয়। এরপর প্রস্তাব আসে, ব্যক্তি স্বত্বার মধ্যে ন্যায় এর অবস্থান কোথায়? সেটি আবিষ্কার করার পর একটি শহরের মধ্যেও ন্যায় এর অবস্থান নির্ণয় অনেক সহজ হয়ে যায়। যেহেতু, অনেকগুলো ব্যক্তি নিয়েই একটি শহর গঠিত হয়ে থাকে। সুতরাং, একটি ব্যক্তির মধ্যে ন্যায় এর অবস্থান বের করা গেলেই শহর কিংবা জাতি রাষ্ট্রের মধ্যেও ন্যায়কে খুঁজে পাওয়া যাবে।

সক্রেটিস শেষ পর্যন্ত এই উপসংহারে পৌঁছান যে, প্রতিটি ব্যক্তি যদি নিজ নিজ কাজ সঠিকভাবে করে তবে সেটাই হচ্ছে ন্যায়। এর মানে দাঁড়ায়, প্রত্যেকটি মানুষ যদি তাঁর নিজ নিজ কাজে সমাজের মধ্যে সঠিকভাবে এবং দায়িত্বপূর্ণ ভাবে পালন করতে পারে তবে সেখানে অবশ্যয় ন্যায় খুঁজে পাওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি যে একটি সমাজে সকল পেশাজীবী মানুষের বসবাস থাকে। যেমন- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, সৈনিক, রাজনীতিবিদ এবং আরো অনেক রকম পেশাজীবীর মানুষ বর্তমান থাকে। প্লেটোর মতে, এই পেশাজীবীরা যদি তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে এবং তাঁরা একের অধিক অর্থাৎ একজন পেশাজীবী যে কাজে পারঙ্গম সে শুধু সেই কাজটিই করবে। এর কারণ হচ্ছে, একজন মানুষ কখনোই একের অধিক বিষয়ে পারঙ্গম হতে পারে না।

আমরা বর্তমান কালে দেখি যে, প্লেটোর এই যুক্তিটি সত্য নয়। কিন্তু প্লেটো যুক্তির মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, একজন যদি নিজের পেশার কাজ শেষ করে অন্য আরেকটি পেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে কোনটিই সবচেয়ে ভালোভাবে করা সম্ভব হবে না। যেমন একজন ডাক্তার যদি ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে ডাক্তার এর প্রধান যে কাজ রোগী দেখে রোগীকে রোগ থেকে মুক্ত করতে সহয়তা করা; সেটি সে সর্বোত্তমভাবে করতে অপারগ হয়ে যাবে। ঠিক তেমনিভাবে এটি সত্য সকল পেশার ক্ষেত্রেই।

সুতরাং, একটি ন্যায় সঙ্গত সমাজে কিংবা শহরে, সবাই সবার পরিপূরক হয়ে উঠবে।

ন্যায়ের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদান

প্লেটো ন্যায় এর সংজ্ঞা আবিষ্কার করতে গিয়ে ‘’উন্নত মিথ্যার’’ আশ্রয় নেন। যেটি অনেকটা বর্তমান কিংবা তৎকালীন সমাজের ধর্মের মতো। এই অবতারনাটি অবশ্যয় সমাজের কিংবা দেশের কিংবা একজন ব্যক্তির আত্মার পরিশোধনের কাজে ব্যবহৃত হবে যা বৃহৎ অর্থে সমাজকে সুচারুভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করবে। এই উন্নত মিথ্যার অবতারনা করবে একজন প্রকৃত নেতা যিনি তাঁর অনুসারীদেরকে উন্নত আলোর পথের দিকে নিয়ে যাবে।

প্লেটো উদ্ভাবিত আত্মার এই ত্রিমুখী তত্ত্ব অনেকগুলো উন্নত মিথ্যার মধ্যে একটি যেটি কিনা সমাজ কিংবা একজন ব্যক্তিকে তিনটি উপাদানে বিভক্ত করবে।

১। যুক্তিঃ  প্রথম উপাদান হচ্ছে যুক্তি। যুক্তির মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তাঁর আত্মা কিংবা বিবেক বুদ্ধি দিয়ে নির্ধারণ করবে কোনটি ভালো এবং কোনটি মন্দ। ভালো মন্দ নির্ধারণের পর একজন ব্যক্তি অবশ্যয় ভালো পথটি অনুসরণ করবে। প্লেটোর মতে, যদি একজন ব্যক্তি বুঝতে পারে কোনটি ভালো এবং কোনটি মন্দ তাহলে তাঁর দ্বারা মন্দ কাজটি করা কখনোই সম্ভব হবে না। এটি একটি ঐতিহাসিক যুক্তি যা সক্রেটিসের প্যারাডক্স নামে বহুল পরিচিত।

ঠিক একইভাবে, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের মধ্যে একজন অভিভাবক থাকবে যিনি বা যারা আইন প্রণয়ন করবেন সঠিকভাবে এবং ন্যাসঙ্গতভাবে দেশকে পরিচালনা করবেন। এটি মূলত ব্যক্তি শ্রেণীর ক্ষেত্রে আত্মার সমতুল্য। এবং প্লেটো এই অভিভাবক শ্রেণীকে অবশ্যয় দার্শনিক হতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। কারণ, একমাত্র দার্শনিকরাই পারেন তাঁদের জ্ঞান দিয়ে সঠিক সত্যটিকে খুঁজে বের করতে। আর এই সঠিক সত্য ছাড়া আইন প্রণয়নও সঠিকভাবে হবে না। আর তা নাহলে আমরা দেখবো একটি অসম্পূর্ণ সমাজব্যবস্থা। কারণ সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে এই অভিভাবক তথা দার্শনিক সম্প্রদায়।

সুতরাং, তিনটি উপাদানের মধ্যে যুক্তি হচ্ছে ‘’GOLDEN RULES’’

২। আত্মাঃ আত্মা হচ্ছে দ্বিতীয় উপাদান। এই উপাদান মানুষের আবেগ এবং যুক্তির মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করবে। যদি সঠিকভাবে আবেগ এবং যুক্তির প্রয়োগ না হয় তাহলে আমরা সবাই জানি যেকোনো মানুষ প্রতারিত হতে বাধ্য। তাই আবেগ এবং যুক্তির মধ্যে একটি সমতাপূর্ণ সাম্যঅবস্থা বজায় থাকতে হবে।

সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় উপাদানটি হচ্ছে দেশের সৈন্যবাহিনী। যারা শান্তির সময় সমাজে বিভিন্নভাবে কাজে লিপ্ত থাকবে এবং যুদ্ধের সময় সকল কাজ বাদ দিয়ে দেশের কিংবা সমাজের জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

এই উপাদানটিকে বলা হচ্ছে ‘’SILVER RULES’’

৩। আকাঙ্ক্ষাঃ এটি হচ্ছে তৃতীয় এবং সর্বশেষ উপাদান। বোঝায় যাচ্ছে, প্লেটো বর্ণিত কাল্পনিক রাষ্ট্রে এই উপাদানটির অবস্থান ‘’BRONZE RULES’’

একজন ব্যক্তির কাছে এই উপাদানটি হচ্ছে খাবারের জন্য ক্ষুধা, কোন কিছুর প্রতি কামনা, ঘুম ইত্যাদি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা প্রবাহ।

ঠিক অপরদিকে একটি সমাজ কিংবা জাতি রাষ্ট্রের মধ্যে, এই উপাদানটি হচ্ছে সকল পেশাজীবীর জনগণ যাদের জন্য উপরে উল্লেখিত উপাদান দুইটি ব্যবহৃত হবে।

প্লেটোর ইউটোপিয়া

প্লেটোর ইউটোপিয়া কিংবা রূপক গুহা দর্শন শাস্ত্রের সবচেয়ে সুন্দরতম আবিষ্কার যা ২৫০০ বছর আগেও সত্য ছিল, এখনো সত্য আছে এবং কালের সমাপ্তির সময়ও যা সত্য থাকবে। রূপক গুহার বিবরণঃ

‘’কল্পনা করো, সমগ্র মনুষ্যজাতি মাটির নিচে একটি গুহার মধ্যে বসবাস করছে। পৃথিবীপৃষ্ঠের আলোর দিকে গুহার একটি মুখ আছে। মুখটি ভূপৃষ্ঠ থেকে গুহা পর্যন্ত দীর্ঘ। এই গুহার মধ্যে মনুষ্যজাতি তাঁদের জন্মের পড় থেকেই রয়েছে। তাঁদের পা এবং গলা শেকল দিয়ে আবদ্ধ। ডানে, বাঁয়ে কিংবা পেছনে তাঁরা মুখ ফেরাতে অক্ষম। শেকল তাঁদের মাথার এরূপ সঞ্চালনকে আঁটকে রাখে। গুহার দেয়ালের দিকেই তাঁদের মুখ ঘোরানো। সুতরাং তাঁরা কেবলমাত্র তাঁদের সম্মুখের দেয়ালকেই তাঁরা দেখতে পাই। এবার কল্পনা করা যাক, তাঁদের পশ্চাতে মাটির উপরে গুহার বাইরে কিছুদূর আগুণ জ্বলছে। বন্দি মনুষ্যপ্রজাতি এবং বাইরের এই আগুণের মধ্যভাগ্যে রয়েছে উঁচু একটি পথ। খেয়াল করলে বোঝা যাবে এই পথ ধরে তৈরি হয়েছে নিচু একটি দেয়াল, একটি পর্দার মতো, যেমন ছায়ানৃত্যের নৃত্যশিল্পীর সামনে থাকে, যে পর্দার উপর শিল্পীরা তাঁদের পুতুলনিয়ে পুতুল নাচ দেখাই।

এইবার কল্পনা করো, নিচু দেয়ালটির পথ ধরে একদল লোক চলে যাচ্ছে। তাঁদের হাতে বিভিন্ন রকম বস্তু আছে। পাথর, কাঠ, নানা রকমের পাত্র, মূর্তি কিংবা পশুর প্রতিকৃতি। এরা কেউ কেউ কথা বলছে। কেউ নীরবে অগ্রসর হচ্ছে। আর এই শোভাযাত্রার ছবিটি আগুণের আলোতে গুহার ভিতরে তাঁর দেয়ালে এসে প্রতিফলিত হচ্ছে।‘’

প্লেটোর এই রূপক গুহার মনুষ্য প্রজাতির মতো বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং অতীতের যতো মানুষ সমাজে এসেছে সবাই। এখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উথাপন করা যাক।

এক, গুহার ভেতরের মনুষ্য প্রজাতি আসলে কি দেখতে পাচ্ছে? তাঁরা বাইরের মিছিলে যেসব দ্রব্য হাতে করে নিয়ে যাচ্ছে তার প্রতিফলন ঘটছে দেয়ালে। যেহেতু বন্দীদের মাথা সঞ্চালন সম্ভব নয়, সুতরাং তাঁরা কেবল দেয়ালে প্রতিফলিত ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখছে না। যদি ধরি তাঁরা পরস্পরের মধ্যে কথা বলছে তাহলে তাঁরা শুধু এই প্রতিফলিত ছায়া নিয়েই কেবলমাত্র কথা বলবে কারণ এর বাইরে তাঁরা কিছু জানে না।

দুই, আমরা সবাই জানি গুহার মধ্যে শব্দ প্রতিধ্বনি হই। সুতরাং পথ ধরে মিছিল যাওয়ার সময় যে শব্দ হচ্ছে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হবে এবং মনুষ্যজাতি মনে করবে এই শব্দ হচ্ছে দেয়ালের প্রতিফলিত ছবির শব্দ।

তিন, এইবার কল্পনা করা যাক বন্দীরা যদি মুক্তি পাই এবং তাঁদের ভুল ভাঙ্গে তা হোলে কি ঘটবে? এদের মধ্যে কেউ একজন যদি হঠাৎ মুক্তি পেয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং মুখ ঘুরিয়ে আলোর দিকে ছুটে তাহলে প্রথমেই সে তীব্র যন্ত্রণা বোধ করবে। আলোর ঝলক তাঁর চোখকে ধাধিয়ে দেবে। যে প্রতিকৃতি সে তাঁর সারাজীবন দেখে এসেছে সে তাঁর কোন কিছুই দেখতে পাবে না এবং চোখ ধাঁধানোর পর ধীরে ধীরে চোখ যখন ঠিক হবে তখন সে দেয়াল, মিছিল, পথ সবই দেখবে। তখন তাঁর কাছে মনে হবে এতকাল সে যা দেখেছে সব ভ্রান্ত। এখন কেউ যদি মিছিলের দ্রব্য গুলির নাম বলতে বলে সে নাম গুলো অবশ্যয় বলতে পারবে না। তাঁর কাছে মনে হবে যে ছায়া সে পূর্বে দেখেছে তাঁর চেয়ে অধিক সত্য হচ্ছে এখন সে যা দেখছে।

চার, এখন যদি সেই মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি গুহা থেকে বের হয়ে সূর্যের আলোর নিচে আসে তবে প্রথমে সে সূর্যের আলোর তীব্রতায় সে কিছুই দেখতে পাবে না। তাঁর চোখে তীব্র জালা হবে। এর অর্থ তাঁর চোখকে বাইরের দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত হতে হবে। ধীরে ধীরে সে বাইরের জগতের গাছপালা, চাঁদের আলো, নক্ষত্রখচিত আকাশের তারার দিকে তাকাবে এবং সব শেষে সে সূর্যের আলোকেও বাস্তব অভিজ্ঞতা সহ দেখতে পারবে। পরবর্তীতে সে নিজের বিষয়ে চিন্তা করবে।

এই রূপক গুহাতে গুহার বন্দিশালা হচ্ছে আমাদের দৃশ্যজগত, মশাল মিছিলের আলো হচ্ছে সূর্য। আর গুহা থেকে উপরে উঠাকে আত্মার মুক্তি অর্থাৎ বুদ্ধির জগতে আত্মার আরোহণ বলে কল্পনা করতে পারি। এই রূপক সত্য কিংবা মিথ্যা যাই হোক না কেন, জ্ঞানের জগতে উত্তমের ভাব আমরা সবার শেষেই অর্জন করতে পারি। এবং এই উত্তমের জ্ঞান কখনো সহজ সরল পথ নয়। এটিতে পৌঁছাতে গেলে অনেক বন্ধুর কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে তবেই এই উত্তম অর্জন করা সম্ভব। আর এই উত্তমের জন্য দরকার হচ্ছে সত্য জ্ঞানের পথে অগাধ বিচরণ। তবেই কেবলমাত্র বোঝা যাবে, উত্তম হচ্ছে সত্য এবং প্রকৃত বুদ্ধির মূল।

(এই বিভাগের লেখা ও মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত মতামতের সাথে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের মতামতের সামঞ্জস্য নাও থাকতে পারে। আমাদের সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করা যেকোন ধারণা ও লেখার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।)

Leave a Comment

Scroll to Top