পার্বত্য অঞ্চলে কুকি-চীনের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও নিরাপত্তা সংকটে সরকারের করণীয়

সারসংক্ষেপে সাম্প্রতিক ইতিহাসঃ

বিগত ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মত জনসম্মুখে প্রকাশ ঘটে কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ নামক একটি পাহাড়ী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর। বম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই সংগঠনটি মূলত ৬টি পাহাড়ী ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করছে বলে দাবী করে। সেগুলো হচ্ছেঃ বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, ম্রো ও খুমি। এই ছয়টি সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির বাইরে অবহেলিত ক্ষুদ্র সম্প্রদায়। 

২০০৮ সালে কেএনডিও (Kuki-Chin National Development Organisation) নামের একটি এনজিওর মাধ্যমে সংগঠনটির আবির্ভাব ঘটলেও ২০২১ সালে ১৫-২০ সদস্যের একটি দল মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়ার মাধ্যমে কেএনএ (Kuki-Chin National Army) সশস্ত্র গোষ্ঠী রূপে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সর্বমোট ৯টি বড়সড় সন্ত্রাসী অপারেশন চালিয়েছে গোষ্ঠীটি।

যারমধ্যে সম্প্রতি এপ্রিলের ৩ তারিখ বান্দরবানের থানচি ও রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক সহ মোট তিনটি ব্যাংকে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ১৭লাখ টাকা ব্যাংক ডাকাতি, এবং পরদিনই ৪ঠা এপ্রিল থানচি থানায় ৭০জন ও ৩০জনের দুটি সশস্ত্র দল নিয়ে থানা আক্রমণ, অস্ত্র লুট ও আলীকদমে পুলিশ চৌঁকি আক্রমণের ঘটনা ঘটে।

এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সংগঠনটির সশস্ত্র কার্যক্রম বেশ সুসংগঠিত, এবং পাহাড়ের ভৌগোলিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গেরিলা ধাঁচের কর্ম-তৎপরতার চেষ্টা চালাচ্ছে।

শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই কুকি-চিনের ৪টি অপারেশনে ৫ জন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য নিহত (অফিশিয়ালি) ও বেশকিছু সদস্য আহত হন।

No Full State, No Rest” স্লোগান ব্যবহার করা কেএনএ বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার উল্লিখিত ছয়টি নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত মোট ৯টি উপজেলা; ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশ নিয়ে গ্রেটার কুকিল্যাণ্ড বা দেশ গঠন করতে চাচ্ছে। বান্দরবানের রুমা, ও থানচি কুকিদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি। এছাড়াও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, লামা ও আলীকদম, এবং রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, ও বিলাইছড়ি নিয়ে গঠিত কথিত নতুন দেশের মানচিত্র ও নিজস্ব পতাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। 

বিগত ২০২২ সালে আবারও ৩০-৩৫ সদস্যের আরেকটি দল মিয়ানমার থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে, দেশে ফিরে বান্দরবানের থানচি ও রুমা উপজেলার সিলোপি পাড়া, ও থিংদলতেপাড়ায় দুর্গম পাহাড়ের গহীনে ঘাঁটি তৈরি করে। আধুনিক চাইনিজ বন্দুকসহ, একে-৪৭, বিভিন্ন স্টেনগান এমনকি পাহাড়ী অঞ্চলে বিদ্যুতের কাজে ব্যবহৃত ব্যাটারি দিয়ে IED (Improvised Explosive Device) বোমা তৈরি করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে সংগঠনটি। সিলোপি ও থিংদলতেপাড়ায় গতবছর পয়লা জুন সেনাবাহিনী অপারেশন চালিয়ে এসকল অস্ত্রসহ কেএনএর মোট ৪৭জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। 

কিন্তু পাহাড়ে এই নিরাপত্তা সংকট কেন বারবার দেখা দিচ্ছে? সরকারের ভুল পদক্ষেপ কিংবা গাফিলতি কোথায়? এর পূর্ণাঙ্গ সমাধানই বা কি? চলুন জেনে নিই!

★ পার্বত্য অঞ্চলে বারবার সশস্ত্র তৎপরতার কারণঃ

  • সকল ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের শান্তিচুক্তির আওতাভুক্ত করতে না পারা, এবং শান্তিচুক্তির আওতাধীন জনগোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তার রোধ করতে না পারা পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা সংকটের একটি বড় কারণ।

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর  যে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়, তা ছিলো মূলত তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যকার শান্তিচুক্তি৷ যাদের মূল নেতা ছিলেন সন্তু লারমা ও মূল জনগোষ্ঠী চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা। ফলে, শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হলেও পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র তৎপরতা সম্পূর্ণ কমাতে পারেনি। কারণ, এই তিনটি তুলনামূলক বৃহৎ নৃগোষ্ঠী ব্যতীত বাকি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীগুলো আলোচনার টেবিলে বসার সুযোগই পায়নি। এটা ছাড়াও, ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমাদের ভেতরও আন্তঃকোন্দল ছিলো নানা বিষয়ে। ফলে, শান্তিচুক্তির কিছুদিনের মধ্যেই চুক্তির বিভিন্ন ধারাকে কেন্দ্র করে জনসংহতি সমিতি ভেঙে ইউপিডিএফ সহ বেশ কয়েকটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়, যাদের মধ্যে একে অন্যের সাথে এখনও কোন্দল বিদ্যমান। এখানে বলে রাখা ভালো, এই কোন্দল কেবলমাত্র শান্তিচুক্তিতে সাক্ষরকৃত তিনটি জনগোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। যা আমরা মূলধারার গণমাধ্যমে এবং সচরাচর পাহাড়ের রাজনৈতিক সংকটে দেখে আসছি। যেমনঃ জনসংহতি সমিতি, জনসংহতি সমিতি (সংস্থারপন্থী), ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক ইত্যাদি গ্রুপের সঙ্গে। আর এইসকল দলের পার্বত্য অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে চলা অন্য গোষ্ঠীর ওপর চাঁদাবাজি, ও আধিপত্যবিস্তারের রাজনীতি পাহাড়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলেছে দীর্ঘদিন যাবত।

এ তো গেলো মূলধারার সংকট;

কিন্তু কুকি-চিনের উত্থান, এবং এর রাজনৈতিক ও সামরিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম মূলধারার সংকটের চেয়ে আরো অনেক গভীর।

এর পেছনে রয়েছে এই সম্পূর্ণ দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে এই জাতিগোষ্ঠীর ওপর দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চাঁদাবাজি,রাজনৈতিক প্রতিনিধির অভাব, প্রশাসনিক কাঠামোতে পিছিয়ে পড়া, এবং  নিজ মাতৃভূমিতে নিরাপত্তা সংকটে ভোগা- এ সবকিছুই এসকল ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীগুলোর ফুঁসে ওঠার কারণ।

  • ত্রিদেশীয় ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকটে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ইন্ধন ও মদদ।

খ্রিস্টান ধর্মালম্বী বম সম্প্রদায়কে কুকি-চিন হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ কি? এর কারণ লুকিয়ে আছে এদের বাসস্থান ও ভৌগোলিকভাবে এদের অবস্থানের জন্য।

এদেশে বম সম্প্রদায়ের বসবাসের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বাংলাদেশে এরা বম, ভারতের মিজোরামে কুকি, ও মায়ানমারে চিন নামে পরিচিত এই সম্প্রদায়টি। যার ফলে সম্প্রতি তিনটি দেশ মিলিয়ে গ্রেটার কুকিল্যাণ্ডের প্রকল্প অনুযায়ী এই কুকি-চিনের নামকরণ। এই লক্ষ্যেই তিন দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সুসংগঠিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীরা। এই ত্রিদেশীয় নিরাপত্তা সংকটে প্রতিবেশী দেশের স্বার্থ, ও ইন্ধন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।

প্রতিবেশী মদদদাতা দেশ মায়ানমারের কুকি-চিনের সাথে প্রত্যক্ষ আর্থিক, অস্ত্র সহায়তা ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। কাচিন প্রদেশে বিদ্রোহী হিসেবে প্রবল প্রতাপের সাথেই মায়ানমারের জান্তা বাহিনীর সাথে লড়ে যাচ্ছে কুকি-চীন। আঞ্চলিক অস্ত্রবাজার বেশ সহজলভ্য হওয়ায় মায়ানমার থেকে অস্ত্র বহন ও প্রশিক্ষণ নেয়া সহজ। যার ফলে শুধু মায়ানমারের নিরাপত্তা সংকটই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও একই নিরাপত্তা সংকট বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা প্রবল। তবে এই ইস্যুতে ভারতের ইন্ধন ও সহায়তাও রয়েছে ব্যাপক। কর্ণেল অলী আহাদের বর্ণনায় সাজেক ও মিজোরামের সাথে অস্ত্র চোরাচালান, ক্রয় বিক্রয় সহ, নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের আঁতাত ১৯৮০ থেকেই রয়েছে। এমনকি শান্তি বাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ত্রিপুরা রাজ্য দীর্ঘদিন ব্যবহার হয়ে আসছে।

কথিত আছে, খাগড়াছড়ি জেলার চেঙ্গী ও মাইনি নদীর তীরে এবং পানছড়ি এলাকায় ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ভারতের মিজোরাম পাহাড় থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ এনে জমা করে রাখতো। এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করতো।

অন্যদিকে সম্প্রতি গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, কেএনএ প্রধান নাথান বম দীর্ঘদিন যাবত মিজোরামে পালিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনপ্রকার সহায়তাই পায়নি।

  • পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর স্ব-স্ব ভাবে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারীর অভাব।

জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বকারীর অভাব এই বঞ্চিত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের একত্রিত করেছে, সংগঠিত করেছে, একই সাথে চরমপন্থা অবলম্বনে প্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা, দাবীদাওয়া, ও সামরিক তৎপরতার চাপে বাংলাদেশ সরকার কখনও অন্যান্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর দিকে তেমন নজর দেয়নি। যার ফলে দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ, আঞ্চলিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া, রাজনৈতিকভাবে এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক অভিভাবকশুন্যতা দিনে দিনে এত বড় আঞ্চলিক সংকট সৃষ্টি করেছে।

কেএনএফ প্রধান নাথান বম ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করতে চাইলেও রাজনীতির গ্যারাকলে শেষপর্যন্ত পেরে উঠতে পারেননি। মূলধারার রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলে, কেবল সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পুরো পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বরং সামরিক অপারেশন পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা সংকট ও অঞ্চলের পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের জন্য অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

  • জীবনমানের বেহাল দশা ও আর্থসামাজিক অবস্থার কোন উন্নয়ন না হওয়া।

রাজনৈতিক অংশগ্রহণে শুন্যতা ছাড়াও, গহীন পাহাড়ের জনপদ হওয়ায়, এই জনগোষ্ঠীগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নের চিত্র অত্যন্ত করুণ।

গহীন পাহাড়ে নেই ভালো স্কুল, কলেজ, কিংবা বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই জনগোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিকভাবে যেমন প্রতিনিধিশুন্য তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন অফিসেও এই জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। অন্যদিকে, পাহাড়ে নিত্যনতুন জমি বেদখল, রিসোর্ট নির্মাণ ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম এসব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর জনমনে অনেকটাই বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

লোকবলের দিক দিয়ে, বম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও সর্বসাকুল্যে ৫-৬ হাজারের বেশি নয়। যার ফলে একদিকে গোষ্ঠীটি যেমন নিপীড়িত হচ্ছে বড় সম্প্রদায়গুলোর দ্বারা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয় টিকিয়ে রাখাও দুঃসহ হয়ে উঠছে দিন কে দিন। এসব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীকে মূলধারায় একত্রীকরণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও জীবনমানের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা না হলে আগামীতে সংকট আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে।

  • দেশীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থারগুলোর ক্রমাগত ব্যর্থতা।

নিরাপত্তা পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থার জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দায়ী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ক্রমাগত ব্যর্থতা।

পার্বত্য অঞ্চলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার গাফিলতি দীর্ঘদিন ধরেই বেশ স্পষ্ট। ব্যাপারটা এমন না যে, কুকি-চিন এর উত্থান, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ,  ব্যাংক ডাকাতি কিংবা থানা আক্রমণ কোন বিচ্ছিন্ন ইস্যু। ২০২০ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ীই পার্বত্য অঞ্চলে চাঁদাবাজির পরিমাণ প্রায় চারশো কোটি টাকা। এসবের সাথে কিডন্যাপ, খুন ও গোষ্ঠী ভিত্তিক সংঘাতও জড়িত। তাই, ২০২২ সালে কেএনএফের উত্থান কিংবা পরবর্তী সশস্ত্র আক্রমণ আদতে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এগুলো দীর্ঘদিন যাবত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গাফিলতির ফসল। পার্বত্য অঞ্চলে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা না হলে, আগামীর দিনে সংকট আরো ভয়াবহ রূপ ধারণা করতে পারে।

 

★ কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে শান্তি আলোচনা করা উচিত নয়?

কেএনএফের পক্ষ থেকে এপ্রিলের ২২ তারিখ শান্তি আলোচনা করার কথা থাকলেও কেএনএফের ব্যাংক লুট, ব্যাংক ম্যানেজারকে কিডন্যাপ ও অন্যান্য মুহুর্মুহু সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ফলে শান্তি আলোচনা পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। কিন্তু শান্তি আলোচনার সুযোগ থাকলেও আদতে শান্তি আলোচনায় যাওয়াও উচিত নয়।

কেন?

শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ক্যশৈহ্লা বলেন, ‘২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ মার্চ দুই দফা সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সংলাপে কেএনএফের সব প্রকার সশস্ত্র কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়, কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তি ভঙ্গ করে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।’ – এ ধরনের নানা ঘটনা  বারংবার ঘটে আসছে। ভার্চুয়াল মিটিং, প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বৈঠক, কমিটি গঠন – সর্বোপরি আলোচনায় ডেকে তাদের দাবি-দাওয়াকে গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগ বেশ পুরোনো। বাংলাদেশী সেনাবাহিনীর কম্বিং অপারেশনকালীন সময়ে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে বম নাগরিকদের জেলে রাখা, সেই ১৯৯৭ সাল থেকে চলে আসা “মুক্তির প্রত্যাশায়” চলমান “শান্তি আলোচনার আশ্বাস” এবং পাশাপাশি কেএনএফের দাবির প্রসঙ্গে সরকারের প্রতিনিধির কাছে উত্থাপিত প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না পাওয়া, কেএনএফের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী ও গোয়েন্দা লেলিয়ে দেওয়া, বমদের প্রতি মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ সহায়তা না করে বান্দরবান জেলা পরিষদে ৫৭ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য গুদামজাত করে রাখা ইত্যাদি ঘটনাতো রয়েছেই! কোনো আঙ্গিকেই তাই শান্তি আলোচনা আর কোনো সমাধানের পথ আনয়ন করে বলে চিন্তা করার সুযোগ নেই।

 

আবার, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক কিন্তু একমুখী। নাগরিক রাষ্ট্রের আনুগত্য ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে এবং সেই অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। যদি তার বাত্যয় ঘটে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের যে সামাজিক চুক্তি তা ভঙ্গ হয়, সেক্ষেত্রে নাগরিক তাঁর মৌলিক সুযোগ সুবিধার জন্যে প্রশ্ন তুলতেই পারে। এমনকি নাগরিক কাঠামোর সংস্কারের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচিও ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু কোন কর্মসূচিই রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের যে একমুখী সম্পর্ক ও আনুগত্য তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনা। এমনকি রাষ্ট্র থিওর‍্যাটিক্যালি নাগরিকের সঙ্গে সংলাপেও বসতে পারেনা। রাষ্ট্র্বের সাথে নাগরিকের কখনও সংলাপ হয়না কারণ, রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক একইসাথে একটি উপাদান ও  আনুগত্যকারী দল হিসেবে।

নাগরিকের সাথে রাষ্ট্রের যা হতে পারে তা কেবলই দাবী আদায়ের জন্য নাগরিক কাঠামোর অধীনে থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা, অবশ্য তা রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক দুই’ই হতে পারে।

কিন্তু,

যদি কোন নাগরিক কর্মসূচি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকেই অস্বীকার করে কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ চালায় তখন সে আর ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক থাকে না, সে হয়ে পড়ে রাষ্ট্রহীন বিচ্ছিন্নতাবাদী। বর্তমানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের কার্যক্রমও সেরকম বিচ্ছিন্নতাবাদী। যা রাষ্ট্র যে একমাত্র পলিটিক্যাল কিংবা একমাত্র সার্বভৌমত্বের অধিকারী, সেই অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে। 

ফলে, রাষ্ট্রের সাথে একই টেবিলে বসে সংলাপের কোন সুযোগই কেএনএফ রাখেনি। 

সম্প্রতি এপ্রিলের ২২ তারিখ কেএনএফের সাথে সেনাবাহিনীর শান্তি আলোচনা হওয়ার কথা ছিলো। সেই শান্তি আলোচনা যে আদতেও কার্যকর করা সম্ভব নয়, তা যেমন থিওর‍্যাটিক্যালি সত্যি একই সাথে প্র‍্যাকটিক্যালিও তাদের দাবীদাওয়া রাষ্ট্র চাইলেও তা পূরণ করা সম্ভব নয়। কেএনএফের শান্তি আলোচনায় দাবী দাওয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো পাহাড় থেকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প এবং ক্যান্টনমেন্ট উচ্ছেদ করা। 

বিগত ২৭ বছরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চল থেকে সর্বমোট ১১৯টি ক্যাম্প সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে, ইউপিডিএফ, জেএসএসের পক্ষ থেকে কি সম্ভব হয়েছে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, আধিপত্যের রাজনীতি, কিংবা পাহাড়কে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ করা? হয়নি।

সুতরাং, পার্বত্য শান্তিচুক্তি যেমন বিগত ২৭ বছরেও পাহাড়ে শান্তি পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে পারেনি, তেমনি কেএনএফের সাথে আরেকটি শান্তি আলোচনা কিংবা সংলাপও পাহাড়ে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে তার কোনপ্রকার নিশ্চয়তা নেই। 

এমনকি কেএনএফ নিজেও সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কারণ, এপ্রিলের ২২ তারিখ যাদের শান্তি আলোচনায় বসার কথা তারা নিজেরাই সংলাপের পথে না এগিয়ে সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছে।

সুতরাং, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনপ্রকার আপস কিংবা শান্তি আলোচনা আদতে ফলপ্রসূ হবে না।

 

★সংকট মোকাবেলায় যা করণীয়ঃ

 

সীমান্ত সুরক্ষিত করাঃ

পাহাড়ে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীদের প্রতিবেশী দেশগুলো মদদ দিচ্ছে বলে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ নিজেই বক্তব্য দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে সর্বপ্রথম দেশের সীমান্ত সুরক্ষিত করা জরুরি। সম্প্রতি মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ফলে বান্দরবানের বেশকয়েকটি সীমান্ত এলাকায় অস্ত্রের যোগান ও সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর আনাগোনা বেড়েছে। এছাড়াও বান্দরবানের বড়মদক, রোয়াংছড়ি সহ বেশকিছু দুর্গম অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান নেই বললেই চলে। বড়মদকের এমনও এলাকা আছে যেখানে বাংলাদেশের জমিতে আরাকান আর্মির পতাকা ওড়ে, আরাকান আর্মির ঘাঁটি রয়েছে। যা স্পষ্টই সার্বভৌমত্বের লংঘন। এসকল অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শুধু জোরদারই নয়, বরং নিশ্ছিদ্র করতে হবে। সীমান্ত সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত করা না গেলে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থের বলি হতে থাকবে বাংলাদেশ।

অভ্যন্তরীণ অভিযান চলমান রাখা ও পূর্ণাঙ্গ নিরস্ত্রীকরণঃ 

পাহাড়ে সেনা হত্যা, সশস্ত্র কার্যক্রম, ব্যাংক ডাকাতি ও থানা আক্রমণের পর কুকি-চিন নিয়ে বেশ কয়েকটি উপসংহারে আসা যেতে পারে। 

১. এরা বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের মত অস্ত্রাগার লুট করছে এবং সামরিক কায়দায় আলাদা রাষ্ট্রগঠন করতে চায়। ২. শুধুমাত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায়, অভ্যন্তরীণ আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। ৩. গ্রেটার কুকিল্যাণ্ডের নাম করে এই বৃহৎ দক্ষিণ-এশীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা ঝুঁকি উস্কে দিতে বড় কোন মহল কাজ করছে। এখানে বলে রাখা ভালো, সম্প্রতি সময়ে কুকি-চিন সদস্যরা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ফ্ল্যাগকে নিজেদের মতাদর্শের বলে পরিচয় দিয়েছে।

সমস্যা যাই হোক, ইতিমধ্যেই তা দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। তাই সামরিক অভিযানকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই।

সাময়িকভাবে ভায়োলেন্স নির্মূল ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে হলেও সম্পূর্ণরূপে চিরুনি অভিযান চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এটা সময়সাপেক্ষ অভিযান হলেও এর কোন বিকল্প বর্তমানে নেই।

তবে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, সামরিক অভিযান একটি সাময়িক সময়ের জন্য অস্থায়ী নিরস্ত্রীকরণের সমাধান কেবল। দীর্ঘস্থায়ী ও পূর্ণাঙ্গ সমাধানের জন্য বহুমাত্রিক পদক্ষেপের প্রয়োজন।

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রতিনিধিত্বকরণঃ 

রাজনৈতিকভাবে এই জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকরণ একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া ও স্থায়ী সমাধানের অংশ। শান্তিচুক্তি সংস্কার করা, সকল জাতিগোষ্ঠীর সমান সুযোগ ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, একপাক্ষিক চাকমা মারমা কিংবা অন্য কোন গোষ্ঠীর একক আধিপত্য বন্ধ করা, এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। সেক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সহ সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার প্রয়োজন। এর পাশাপাশি, চাকরি, প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পাশাপাশি আঞ্চলিক থেকে জাতীয় সকল পর্যায়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় একত্রীকরণের দায়ভারও রাষ্ট্রের।

পাহাড়ে যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ, নগরায়ন ও উচ্ছেদ বন্ধ করাঃ

পাহাড়ে যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ, নগরায়ন, ভূমি বেদখল, ও জোরপূর্বক উচ্ছেদ কোন বিচ্ছিন্ন ইস্যু নয়। চিম্বুক পাহাড় থেকে সাজেকের রিসোর্ট নির্মাণ- সব একই সূত্রে গাঁথা। যত্রতত্র অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের রাজনীতি কতটা ভয়াবহ তা কয়েকটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। ২০২০ সালে ম্রো জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণের চেষ্টা করা হয়, যা মানবাধিকার ও সংবিধান উভয়েরই পরিপন্থী। অন্যদিকে, ২০২২সালে বান্দরবানের লামায় ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০০ একর জুমচাষের জমি পুড়িয়ে ও পানির ঝর্ণা বিনষ্টের মাধ্যমে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার চেষ্টা করা হয়। এভাবে ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ আর মাস্টারপ্ল্যান বিহীন পাহাড় কেটে যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ চালিয়ে গেলে পাহাড়ে শান্তি ফেরানো কখনই সম্ভব হবেনা। এ প্রসঙ্গে একদিকে সেনা-পাহাড়ীদের মধ্যকার সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একই সাথে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেও রাষ্ট্রের আপোস করার কোন সুযোগ নেই।

 

Reference

  1. https://bipss.org.bd/evolution-of-kuki-chin-national-front-as-a-separatistgroup-and-impact-on-national-and-regional-security/
  2. https://www.channelionline.com/shooting-terrorists-police-going-thanchi/
  3. https://www.tbsnews.net/bangladesh/who-are-kuki-chin-army-chittagong-hill-tracts-633414
  4. https://www.newsbangla24.com/news/242435/Peace-talks-with-Kuki-China-arspended-due-to-violation-of-treaty-terms
  5. https://bangla.bdnews24.com/opinion/4j6qobd7bz

 

✍️ Written by-

Mohammad Sadik Al Rajin

Associate, Foreign Policy

Edited by:

Nusanta Samayel Audri

Lead, Foreign Policy

Infographics: Social Media team & Nusanta Samayel Audri

Scroll to Top