বুক রিভিউঃ লেভিয়াথান (থমাস হবস), পর্যালোচকঃ হোসনাইন আর. সানি

যে বিষয়টি আমাদের সবার জানতে হবে

ইউরোপে রেনেসাঁ যুগের পরবর্তী কয়েকটি দার্শনিকের মধ্যে হবস অন্যতম। কিন্তু হবস এমন একজন দার্শনিক ছিলেন যাকে কোন শ্রেণীতে শ্রেণীভুক্ত করা অন্যতম কঠিন কাজ। এর কারণ হিসেবে তাঁর লেখাগুলোর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেই টের পাওয়া যায়। তিনি অন্যান্য দার্শনিকদের মতো যেমন ছিলেন সম্পূর্ণ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আরোহীত একজন পণ্ডিত; ঠিক তেমনি তিনি অন্যান্য দার্শনিকদের থেকে একটু ব্যতিক্রম ও ছিলেন বটে। গণিতের প্রতি তাঁর অনুরাগ তাঁকে এই ব্যতিক্রমী দার্শনিক হিসেবে ইতিহাসে সমৃদ্ধি দান করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ইউরোপের দার্শনিকদের মধ্যে এই বিশুদ্ধ গাণিতিক পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যেতো না। ব্যতিক্রম হিসেবে আমরা রেনে দেকারত কিংবা বারত্রান্ড রাসেল কে মনে করতে পারি। কিন্তু একটি জায়গায় হবস এই দুই দার্শনিকের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। কারণ, দেকারত যেখানে শুধুমাত্র মনস্তত্ব ও গণিত নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন কিন্তু সমাজ কিংবা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে গেছেন। রাসেলের ক্ষেত্রেও এটি সমানভাবে সত্য। আর হবস ব্যতিক্রমী। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে গণিত দ্বারা প্রভাবিত দর্শনে একটি ভুল ধারনায় উপনীত হওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। কিন্তু হবসের দর্শনে আমরা সেই জিনিসটির সন্ধান পায় না। হবসের চিন্তাভাবনায় কিছু ত্রুটিপূর্ণ বিষয়ও পরিলক্ষিত হয়। সূক্ষ্ম দার্শনিক বিষয় আলোচনায় তিনি ছিলেন অধৈর্যশীল এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি সকল সমস্যার দূর করতে চাইতেন। যার প্রতিফলন ঘটেছে হবসের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘’লেভিয়াথান’’-এ। কিন্তু এই লেভিয়াথানেই তিনি আবার দেখিয়েছেন কোন সমস্যার সমাধানকল্পে কিভাবে কঠিন জিনিসগুলোকে বাদ দিয়ে সহজভাবে সমাধানে পৌঁছানো যায়। তাঁর রাষ্ট্র সম্পর্কে মতবাদ তাঁর পরবর্তী অনেক বিখ্যাত দার্শনিকের আধুনিক মতবাদের চেয়েও আধুনিক। উদাহরণ হিসেবে আমরা ম্যাকিয়াভ্যালির কথা বলতে পারি।

মূল উপজীব্য

হবস তাঁর লেভিয়াথান গ্রন্থে উপস্থাপিত রাজনৈতিক মতবাদেই আমৃত্যু বিশ্বাসী ছিলেন। তবে ১৬২৮ সালে পার্লামেন্টে ‘’পিটিশন অফ রাইট’’ (Petition of Right) আইন পাশ হলে তিনি গণতন্ত্রের দোষত্রুটি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাকল্পে থুকিডাইসের অনুবাদ প্রকাশ করেন। পড়ে ১৬৪০ সালে লং পার্লামেন্টের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং লাউড ও স্ট্রাফর্দ কে জেলে প্রেরণ করা হলে হবস ভীত হয়ে প্যারিসে পালিয়ে যান।

লেভিয়াথান গ্রন্থের শুরুতেই হবস তাঁর সমগ্র বস্তুবাদী ধারনা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গতি ব্যতীত জীবন আর কিছুই নয়। আর তাই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের কৃত্তিম জীবন রয়েছে। এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বলতে তিনি রাষ্ট্রকে বুঝিয়েছেন। আর এই রাষ্ট্রের আরেক নামই হচ্ছে লেভিয়াথান যা তিনি একমাত্র এই নামে অভিহিত করেন। এই লেভিয়াথান কিংবা প্রজাতন্ত্র মানুষের তৈরি একটু যন্ত্র স্বরূপ মানুষের কিংবা একটি সমাজের সংগঠন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হচ্ছে মানুষের কিংবা সমাজের আত্মা। তাঁর মতে, যে চুক্তি কিংবা চুক্তিপত্র দ্বারা লেভিয়াথান এর জন্ম তাতে ঈশ্বরের আদেশই সবচেয়ে উত্তম। কারণ ঈশ্বর বলেছিলেন, তাহলে মানুষ সৃষ্টি করা যাক। গ্রন্থের প্রথম দিকে আমরা আরো দেখতে পাই, হবস মানুষকে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে স্থান দিয়েছেন এবং সাধারণ দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে ধর্মসমূহ কোন স্বপ্ন থেকে পাওয়া চিন্তক ফসল নই; বরঞ্চ ধর্মসমুহ এসেছে মানুষের জীবনের কঠিনতম বাস্তব অবস্থা থেকে।

হবস মনে করতেন আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সকল প্রকার বিজ্ঞানের মধ্যে জ্যামিতি হচ্ছে সবচেয়ে এবং একমাত্র প্রকৃত বিজ্ঞান। যুক্তির প্রকৃতি কিংবা শুরু হচ্ছে একটি বিষয়ের সংজ্ঞা থেকে। কিন্তু সংজ্ঞায় স্ব-বিরোধী ধারনা পরিহার করা প্রয়োজন যা কিনা দর্শনের সহজাত রূপ নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘’অশরীরী দ্রব্য’’ । তিনি ব্যাখ্যা করেন যে এরূপ শব্দ অর্থহীন। এর বিকল্প হিসেবে হবস দেখিয়েছেন যদি একই ক্ষেত্রে দ্রব্যটিকে ঈশ্বর দ্রব্য বলা হয় তখন সাধারণত দুইটি ভাবে এর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। এক, দর্শনের আলোচিত বিষয় ঈশ্বর নই; দুই, অনেক দার্শনিক যারা ঈশ্বরকে দেহধারী হিসেবে কল্পনা করেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে স্ব-বিরোধীতাই পরিপূর্ণ।

হবস প্লেটোর মতের বিরোধীতা করেন এবং বলেন যে, মানুষের বুদ্ধি সহজাত কোন প্রবৃত্তি নয়। বুদ্ধি পরিশ্রম দ্বারা বিকশিত হয়। হবস এরই সাথে প্লেটোর অনুরূপ আরও অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, প্রেম, আবেগ, কামনা এবং চেষ্টা। তাঁর মতে, কোন মানুষের চেষ্টা যদি কোন কিছুর লক্ষ্য নিয়ে সামনে আগাতে থাকে তখন সেটাকে কামনা বলে। আর চেষ্টা যদি কোন লক্ষ্য অর্জন থেকে দূরে থাকে তখন তাঁকে বিরাগ বলে।

হবস তাঁর লেভিয়াথান গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে বলেন যে, সকল মানুষ জন্মগতভাবে সমান। মানুষ রাজ্য গঠনের পূর্বে শুধুমাত্র সে তাঁর স্বাধীনতা রক্ষা করার ইচ্ছাই পোষণ করতো। আবার একই সাথে মানুষ অন্যের অপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেও সচেতন। আত্মরক্ষার তাগিদেই মানুষ এই বহুবিধ চিন্তা দ্বারা পরিচালিত। মানুষের এই দ্বন্দ্ব অবস্থা থেকেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং মানুষ প্রতিযোগিতাই লিপ্ত নেমে পড়েছে। হবস এই সমস্যার সমাধানও করেছেন। হবস ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে মানুষ তাঁর এই অশুভ পরিণতি থেকে বাঁচতে পারবে। তাঁর মতে, মানুষ যদি সমাজবদ্ধ হয়ে একজন কেন্দ্রীয় শাসকের নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং একটি সামাজিক চুক্তির মাধ্যমেই তা কেবলমাত্র সম্ভব। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, একদল মানুষ একত্রিত হয়ে একজন কিংবা একদল সার্বভৌম শাসক চয়ন করতে সম্মত হবে। তারপর এই শাসক বা শাসকগোষ্ঠী তাঁদের অপর অর্পিত দায়িত্ব তাঁদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রজাতন্ত্রের মানুষদের অবিরাম যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। হবস মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে, পিপীলিকা এবং মৌমাছির পারস্পরিক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করেছেন। এর কারণ হিসেবে হবস দেখিয়েছেন যে, মানুষের মতৈক্য হচ্ছে প্রাকৃতিক। অন্যদিকে পিপীলিকা কিংবা মৌমাছির মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা নেই, নেই কাউকে অসম্মান করার প্রবণতা।

হবস রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বহু ব্যক্তির শাসনের চেয়ে রাজতন্ত্রকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে, তাঁর এই রাজতান্ত্রিক অগ্রাধিকার রাজতন্ত্র থেকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সাহায্যের প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়। সে যাই হোক, হবস একথাও স্বীকার করেছেন যে, প্রজাদের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিলে রাজা সাধারণত তাঁর ব্যক্তি স্বার্থকেই বেশী প্রাধান্য দিবে। বহু ব্যক্তির শাসনের ক্ষেত্রেও এরূপ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। রাজার পছন্দের লোকের রাজদরবারে আধিক্য বেশী থাকবে। বহু ব্যক্তির শাসনের ক্ষেত্রে এটাও হতে পারে। কিন্তু রাজা বিপদে পড়লে সে চুপিসারে সাসনব্যবস্থা থেকে যেকোনো একজনকে পছন্দ করে তাঁর পরামর্শ নিতে পারবে যেটা কিনা বহু ব্যক্তি শাসনের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কারণ তাঁদের ক্ষেত্রে এইরূপ উপদেশ হবে প্রকাশ্য যা সরকারকে কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও বিপদে ফেলবে। অধিকিন্তু, এরূপ শাসন ব্যবস্থায় গৃহযুদ্ধ ঘটার সম্ভাবনাও প্রচুর থাকে যা রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে অনেক সীমিত। এইসব কারণে হবস রাজতন্ত্রকেই সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন।

হবসের মতে, মানুষকে বিক্ষুব্ধ এবং আরও যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্যই প্রাচীন লেখকগণ তাঁদের স্বাধীনতার প্রশংসা করেছেন। তিনি মনে করতেন, প্রাচীনকালের দেশের স্বাধীনতা বলতে শুধুমাত্র বিদেশি শাসকগোষ্ঠী থেকে নিজেদের স্বাধীনতাকেই কল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন দেশের মধ্যেও যে, গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হতে পারে সেটি প্রাচীন যুগের দার্শনিকরা কল্পনায় করতে পারেন নাই। এরই ফলশ্রুতিতে প্রাচীনকালে গণতন্ত্র শাসন ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল যা বর্তমান যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করতেন দার্শনিক হবস।

  

(এই বিভাগের লেখা ও মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত মতামতের সাথে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের মতামতের সামঞ্জস্য নাও থাকতে পারে। আমাদের সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করা যেকোন ধারণা ও লেখার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।)

Leave a Comment

Scroll to Top