বুক রিভিউঃ দি স্টেটসম্যান (প্লেটো), পর্যালোচকঃ হোসনাইন আর. সানি

‘’The Statesman’’- বাংলায় যাকে বলে রাষ্ট্রনায়ক সংলাপটিতে প্লেটো মূলত দার্শনিক  সক্রেটিস, গণিতবিদ থিয়াদরাস, তরুণ সক্রেটিস ( সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক নন, এই তরুণ ছিল প্লেটোর আকাদেমির ছাত্র) এবং ইলিয়বাসী এক আগুন্তকের আলোচনায় আপাতদৃষ্টিতে রাষ্ট্রনায়ককে খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস চালিয়েছেন। এরইসাথে তাঁর স্বরূপ বিশ্লেষণেরও ব্রতী হয়েছেন। সংলাপটিতে এছাড়াও আলোচিত হয় দার্শনিক পদ্ধতি (dialectic system), এই মহাবিশ্বের উৎস এবং তাতে রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং শাসনের প্রয়োজনীয়তা। প্লেটো প্রায় সমধর্মী বিষয় নিয়ে ‘’রিপাবলিক’’ নামে বিপুল আয়তনের যে বইটি রচনা করেছিলেন ধারনা করা হয় সেখানে তিনি নৈতিক মানুষের মন এবং কিভাবে এই নৈতিক মানুষদের দিয়ে একটি নগররাষ্ট্র গঠন করা যায় সেই বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেছিলেন। আইনদাতা হিসেবে প্লেটো রিপাবলিক এ তাই আদর্শ সংবিধানের তথা আদর্শ রাষ্ট্রের চিত্র চিত্রিত করেছেন। এর সাথে আছে ন্যায়নৈতিকতার ব্যবহারিক সমাধান; মানবজীবনের মূল লক্ষ্য ‘’উত্তম’’ এর অর্জনকে সামনে রেখে আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও বিদ্যমা

ন ত্রুটিপূর্ণ সমাজের ব্যাপক সংস্কার সাধন, সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন, নাগরিকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবনকে সবচেয়ে উত্তম রূপে তৈরি করা। কিন্তু একটি প্রশ্ন তথাপি সেখানে না উঠে পারে না? এই যে আদর্শ রাষ্ট্র; সেই আদর্শ রাষ্ট্র তৈরি করতে গেলে নিঃসন্দেহভাবে একজন রাষ্ট্রনায়ক এর প্রয়োজন হবে। সুতরাং প্লেটো তার রাষ্ট্রনায়ক সংলাপের মাধ্যমে সেই অভীষ্ট উদ্দেশ্য পুরোন করারই প্রয়াস চালিয়েছেন।

আলোচ্য সংলাপটিতে আমরা দেখতে পাই যে, তরুণ সক্রেটিস এবং ইলীয় দেশের আগুন্তক রাষ্ট্রনায়কের সন্ধানে শিকারে বের হোন। কিন্তু এই শিকার পশু পাখি শিকারে মতো কোন বিষয় নয়। এই শিকার যুক্তির পর যুক্তি বসিয়ে একজন আরেকজনের যুক্তি খণ্ডন করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকে বোঝায়। এইরকম শিকারের জন্য প্লেটো একটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথমে ইচ্ছা করেই ভুল পথে পরিচালিত হয়েই তিনি সঠিকপথের সন্ধান করেছেন। এর মাধ্যমে এটি পরিষ্কার যে, ভুল না জানলে যেমন সঠিক কোনটি তা বোঝা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে সঠিক জেনেও ভুল টাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সবসময় পারা যায় না।

সংলাপের শুরুটা হয় প্লেটোর আগের সংলাপ গুলোর স্মৃতিচারণ করে। পূর্বের সংলাপগুলোতে আমরা দেখতে পায় যে, জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল প্লেটোর থিয়াইতিতাস গ্রন্থে যেখান থেকে পরবর্তীতে প্লেটো অর্থের বিনিময়ে কিংবা কোন কিছুর বিনিময়ে জ্ঞান দান যারা করে তাদেরকে চিত্রায়িত করেছেন সফিস্ট গ্রন্থটিতে। সক্রেটিস সেইসব আলোচনা স্মরণ করেন এবং থিয়াদরাস নামক এক গণিতবিদ ও তার ছাত্র তরুণ সক্রেটিস জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন আদর্শ ‘’রাষ্ট্রনায়ক’’ এর সংজ্ঞা, তাঁর উদ্ভাবন, অবস্থান সহ তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মূল এই প্রস্তাব ধরেই রাষ্ট্রনায়ক কে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রনায়কত্বকে এক ধরনের যদি আমরা পারদর্শিতা হিসেবে কল্পনা করি তাহলে আমাদের এটাও খুঁজে বের করতে হবে এই রাষ্ট্রনায়ক আসলে কাদের জন্য কাজ করবে। স্বাভাবিক কারণেই সেখানে রাষ্ট্রনায়কের সাথে উঠে আসে গৃহকর্তা, ক্রীতদাসের মালিককুল এবং সমাজের অভিজাততন্ত্রের নাগরিকগণ। রাষ্ট্রনায়কের সংজ্ঞা নিখুঁতভাবে প্রতীয়মান করার জন্য সবগুলো মানুষকে একই কাতারে আবদ্ধ করে ফেলা হয়। যদি কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার জন্য যেই জ্ঞান দরকার সেই জ্ঞানের অধিকারী হন তাহলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্বীকৃত দেয়া যাবে। যুক্তির নিয়ম অনুযায়ী এই অবস্থায় চলে আসে জ্ঞান এর সংজ্ঞা এবং জ্ঞানের প্রকারভেদ।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্লেটো হচ্ছে একমাত্র ব্যক্তি যিনি যুক্তিগত ভাবে জ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করতে এবং জ্ঞানকে দুইভাগে বিভক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। যদিও সেই জ্ঞান প্রকৃতঅর্থে চার (৪) প্রকারের কিন্তু আদতে দুই প্রকার থেকেই পরবর্তীতে বাকী দুই প্রকারের উদ্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অভিভাবকের জ্ঞানকে তিনি ‘’বিচারিক’’ এবং ‘’উপদেশমূলক’’ জ্ঞান হিসেবে দুইভাগে বিভক্ত করেন। এই দুই প্রকারের জ্ঞানকে বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে চিত্রায়িত করে রাষ্ট্রযন্ত্রের এই অভিভাবকের স্বরূপ বুঝতে চেষ্টা করেছেন। সর্বপ্রথম সক্রেটিস একটি ভ্রান্ত ধারনার প্রবর্তন করেন এবং যুক্তি দিয়ে ডায়ালেক্টিক পদ্ধতির মাধ্যমে সংলাপে অংশগ্রহণকারী সবাইকে বোঝাতে সমর্থিত হন যে কেন এই ধারনাটি ভ্রান্ত। এরপর সেই ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে ধীরে ধীরে তিনি সঠিক সংজ্ঞার দিকে অগ্রসরমান হতে থাকেন। এই ভ্রান্ত ধারনাটির উপস্থাপনা মূলত বিভাজন পদ্ধতি হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।

প্রথম সংজ্ঞার অবতারণার পর প্লেটো আলোচনায় এক নতুন প্রসঙ্গের অবতারনা করেন; আর তা হলো তৎকালীন গ্রীক দেশের সোনালি যুগের কিংবদন্তির গল্প। যেখানে ক্রোনাসের যুগের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এই ক্রোনাসের যুগের কাহিনীর কিংবদন্তি হিসেবে খোদ ঈশ্বর কিংবা সৃষ্টিকর্তাকে বোঝানো হয়েছিল। যার আদি আছে কিন্তু শেষ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের অভিভাবক এরতো নিঃশেষ আছে। এই অবস্থায় আসার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল রাষ্ট্রনায়ককে অনুসন্ধান করা। কিন্তু তারা ভ্রান্ত যুক্তির খণ্ডনে পড়ে মূলত ঈশ্বরের আলোচনায় চলে এসেছে। এখান থেক একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই পাঠকদের মনে আসতে বাধ্য যে, প্লেটো কেন এরকম যুক্তির অবতারনা করেছিলেন? সংলাপ এর সামনের দিকে আমরা যতো এগুতে থাকবো বিষয়টি ততো পরিষ্কার হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অভিভাবক হিসেবে ভ্রান্তির প্রমাণের পর দেখা যাবে, প্লেটো সক্রেটিসের মাধ্যমে মানব জাতিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের অভিভাবক হিসেবে অভিহিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে আবার পরিষ্কার ভ্রান্তি দেখা দিবে। কেননা, এই মানব জাতির প্রত্যেকটি মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির। অর্থাৎ কোন মানুষই আরেকটি মানুষের মতো নয়। সুতরাং, তাঁদের শাসনের পদ্ধতিও হবে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন রকমের। কেউ হবে তাঁর আসে পাশের কিংবা কোন মানব প্রজাতির সিদ্ধান্তকে মেনে না নিয়েই নিজের ইচ্ছামত যা খুশী সেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। এই প্রকার রাষ্ট্রনায়ককে বলা হচ্ছে ‘’স্বৈরাচারী’’ শাসক। আবার অপর পক্ষে এমন সহনশীল মানুষও থাকবে যার একমাত্র ব্রত থাকবে মানুষের উপকার অর্থাৎ মানবজাতির উপকার। আর মানব জাতির উপকার করতে গেলে শাসককে অবশ্যয় প্রত্যেক মানুষের ভালো মন্দ তাঁদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই করতে হবে। সুতরাং এই প্রকারের শাসক হবে সত্যিকার রাজা কিংবা সত্যিকার রাষ্ট্রনায়ক। কারণ মানুষের জন্য উন্নতিই হচ্ছে রাষ্ট্রের পরমতম ন্যায় যা প্লেটো তাঁর ‘’রিপাবলিক’’ গ্রন্থটিতে দেখিয়েছেন। প্রকৃতঅর্থে, এই সহনশীল প্রকৃত রাজার শাসনব্যাবস্থায় হচ্ছে বর্তমান কালের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। আর এভাবেই ঠিক ২৫০০ বছর আগে প্লেটো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার উদ্ভাবন করেন যার পরিপূর্ণ রূপ আসে তাঁরই ছাত্র অ্যারিস্টটলের হাত ধরে।

কিন্তু এরপরও দেখা যায় যে, প্লেটো রাষ্ট্রনায়ককে যুক্তি দিয়ে দিয়ে কিভাবে অন্যান্য পেশার মানুষজন থেকে আলাদা কিংবা বিভাজন করবেন। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কোন শিল্প অর্থাৎ কোন পেশাজীবী মানুষ রাষ্ট্রনায়ক হতে পারে না। এর কারণ হচ্ছে, যে ধরনের ব্যক্তিকে কোন কিছুর বিনিময়ে কিংবা পয়সা দিয়ে ভাড়া করা যায়, যারা দৈনিক দিন মজুরের বিনিময়ে কাজ করতে পারঙ্গম, তাঁরা শাসন করার শিল্পে কখনো তাঁদের দাবী উত্থাপন করতে পারে না। এর কারণ হিসেবে প্লেটো তাঁর ‘’রিপাবলিক’’ বইতে দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রের অভিভাবককে অবশ্যয় দার্শনিক হতে হবে। আর দার্শনিক হতে গেলে অবশ্যয় তাঁকে সকল প্রকার মানবিক চাহিদার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। এই মানবিক চাহিদার ঊর্ধ্বে থাকতে গিয়ে একজনকে অবশ্যই সেই বিষয়ে পরিপূরণ জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। কারণ জ্ঞানই হচ্ছে এই পৃথিবীর সকল কিছুর একমাত্র নিয়ামক।

  

(এই বিভাগের লেখা ও মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত মতামতের সাথে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের মতামতের সামঞ্জস্য নাও থাকতে পারে। আমাদের সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করা যেকোন ধারণা ও লেখার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।)

Leave a Comment

Scroll to Top