বুক রিভিউঃ দি গ্রেট পার্টিশন, পর্যালোচকঃ মালিহা আরোশা হাসান

১৯৪৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার চুয়াত্তর বছরের বেশি সময় পরেও আজ অবধি সমানভাবে এর প্রকৃত কারণ ও এর প্রভাব নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। এর কারণ হিসেবে আমরা আর্নল্ড জে টয়েনবির ঐতিহাসিক তত্ত্ব নিয়ে এগুতে পারি। একটা হলো, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং আরেকটি হলো, ঘটনার ক্রমানুসারে ইতিহাসকে পর্যালোচনা করা। এই বইটির সংক্ষিপ্তসার করতে গিয়ে আমাদের দুইটি বিষয়কেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তা নাহলে, আমাদের পাঠকদের কাছে সঠিক তথ্যটি না পৌঁছিয়ে অন্য দ্বিধাবিভক্ত অনেক কিছুই মনে হতে পারে। সেই ১৯৪৭ সাল থেকে চলে আসা বিতর্কগুলো বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তিত হয়েছে এবং সম্ভবত ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রেক্ষাপটের ফলে সেই ১৯৪৭ এর কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে আমাদের একটি প্রশ্ন মাথায় রাখাকে আমি যথার্থ বলে মনে করি। প্রশ্নটি হলো,‘’ ঠিক কি কারণে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের ছোট একটি রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় একটি দল মাত্র নয় (৯) বছরের ব্যবধানে পরবর্তী নির্বাচনের শেষে সম্পূর্ণ আলাদা একটি দেশ এর দাবী করে বসতে পারে?’’  প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা বিরাট একটি আলোচনার ব্যাপার। আমরা সেইদিকে না গিয়ে আপাতত Yasmin Khan রচিত ‘’The Great Partition’’ বইটির দিকে আলোকপাত করি যেটি আমাদের মূল উপজীব্য। এতে আশা করি পুরো উত্তরটা না পাওয়া গেলেও আংশিক উত্তর অবশ্যয় খুঁজে পাওয়া যাবে।

সোজা বাংলা ভাষায় “দেশভাগ” – ব্রিটিশ ভারতকে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুইটি পৃথক স্বাধীন দেশের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর এর প্রক্রিয়ার একটি রূপ। যার মাধ্যমে ব্রিটিশরা কয়েক বছরের রক্তক্ষয়ী আপামর জনগণের সংগ্রামের স্বাধীনতা কীভাবে ঘটবে সে সম্পর্কে চুক্তিটি করতে সক্ষম হয়েছিল। এটা বলাই বাহুল্য যে সেই সময়, খুব কম লোকই বুঝতে পেরেছিল যে দেশভাগটি আসলে কীভাবে ঘটতে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণদের কোথায় নিয়ে যাবে?

যে বিষয়টি আমাদের সবার জানতে হবে 

ব্রিটিশ ভারতের বিভক্ত মাত্র কয়েকটি দিন পঞ্জিকার হিসাব দিয়ে বিচার করলে এর ঐতিহাসিক কারণ সত্য বলে মোটয়েও প্রতীয়মান হবে না। কারণ হিসেবে আমরা ব্রিটিশদের দুইশত বছরের শাসন এবং উপমহাদেশের লোকজনদের শোষিত হওয়ার চিত্র দেখলেই বুঝতে পারি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে মূলত তিনটি (৩) জিনিস। এক, সর্বভারতীয় কংগ্রেস দল এবং এর গঠনতন্ত্র; দুই, মুসলিম লীগের উত্থান এবং তিন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটিশদের আর্থিকভাবে ব্যাপক দৈন্যতা।

কংগ্রেসঃ  ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ নেয়া ব্রিটিশ বিরোধী শাসনের মূল বাহন হিসেবে বলা চলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে, যার সর্বাধিক পরিচিত নেতারা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস এবং মওলানা আবুল কালাম আজাদ। ১৯৪০ এর দশকের আগে থেকেও, এটি দীর্ঘকাল ধরে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র সহ একক রাষ্ট্রের পক্ষে ব্রিটিশদের সাথে আন্দোলন করে আসছিলো। এমনকি একটি সময় মুসলিম লীগের অন্যতম প্রধান নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। কারণ কংগ্রেস নিরপেক্ষভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, সংখ্যালঘু স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থাগুলি কংগ্রেসের এই  ধারণাটিকে সন্দেহের সাথে দেখে আসছিলো কারণ তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে হিন্দুদের প্রায় ৮0% জনগণের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে।

মুসলিম লীগঃ ১৮২৭ সালে ব্রিটিশদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃত জানানো  মুসলমান সমাজ হিন্দুদের চেয়ে ঢের গুনে পিছিয়ে ছিল। ফলশ্রুতিতে তাঁদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারনা হয়েছিল যে, ব্রিটিশরা যদি হিন্দু নেতাদের হাতে দেশের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে যায় তবে মুসলমান সমাজ আরও বেশী নিস্পেশিত ও শোষিত হবে। এর পেছনে নানারূপ আর্থ- সামাজিক অবস্থা, হিন্দু ধর্মের কবিদের নানাভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ছিল মুসলমান সমাজের এই রূপ চেতনার পেছনের কারণ।

ব্রিটিশদের ব্যাপক অর্থনীতি ধ্বসঃ  ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর পুরো পৃথিবীর বৈশ্বিক রাজনীতিতে তখন চলছিলো ক্ষমতার পালাবদলের ঢেউ। এক সময়ের মহা-প্রতাপশালী গ্রেট ব্রিটেন একে একে তাঁদের ঔপনিবেশিকতা ছেড়ে দেশগুলোকে স্বাধীন করে দিচ্ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এমনিতে আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ঔপনিবেশিকতার জন্য যে পরিমাণ অর্থ এবং লোকবল প্রয়োজন ছিল ১৯৪৫ সালের ক্ষমতার পালাবদলের সময়ে সেটি অনেকাংশেই কঠিন হয়ে গেছিল। সাথে ছিল, সোভিয়েত রাশিয়াতে কমিউনিজমের উত্থান এবং প্রায় প্রতি দেশেই কমিউনিস্ট পার্টির একটি বৈপ্লবিক জনসমর্থন।  মোটা দাগে বলতে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তি ছিল একটি অনিস্তারজ ঘটনা। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর ছিল কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার। ইয়াসমিন খান তার বইটিতে সেই ঘটনাবহুল দিনগুলোর চিত্রয় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন।

মূল উপজীব্য

ইয়াসমিন খান তার গ্রন্থে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার করুন ইতিহাস তুলে ধরেছেন। বইটির বিশেষত্ব হলো দেশভাগের চিত্র রাজনৈতিক, সামাজিক, মানসিক এবং তখনকার জনসাধারণের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তুলেছেন। দেশবিভাগের সময় তিনটি দল জড়িত ছিল – কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য।

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে পরাজিত একটি ছোট ধর্মীয় দল ছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু নয় বছরের ব্যবধানে মুসলিম লিগ হয়ে উঠেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক। জিন্নাহ হয়ে উঠেছিলো উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিনিধি । মুসলিম লীগের দাবি ছিলো মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র, যেখানে তারা বৈষম্যের শিকার হবেনা। যুগ যুগ ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছিল মুসলিমরা। তারা অনুভব করেছিল যে মুসলমানরা কোনও আওয়াজ পাচ্ছে না। এটি বোধগম্য কারণ ঐতিহাসিকভাবে, মুসলমানরা ব্রিটিশদের দ্বারা রাজ্যে প্রবর্তিত সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উপাদানগুলিকে গ্রহণ করতে নারাজ ছিল।ফলস্বরূপ, মুসলমানরা সমাজে পিছিয়ে পরেছিল ও ব্রিটিশদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেনি। হিন্দুদের এই কারণে ব্রিটিশদের সাথে আরও ভাল সম্পর্ক ছিল যার ফলস্বরূপ তারা তুলনামুলক বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক মূলধন লাভ করেছিল। মুসলিম লীগ সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে একটি সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র, পাকিস্তানের পক্ষে প্রচন্ডভাবে প্রচারণা চালিয়েছিল এবং মুসলমানদের মধ্যে এক ধরণের মুসলিম জাতীয়তাবাদ তৈরি করেছিল। তবে উপমহাদেশে কোথায় এবং কীভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে সে সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অভাব ছিল।

কংগ্রেস, বিশেষত জওহরলাল নেহেরু সর্বদা একটি বহুত্ববাদী ভারতীয় রাজ্যের জন্য কামনা করেছিলেন এবং যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় সংহতিতে সহাবস্থান করতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে , কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দলটি এক ধরণের হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচারক হয়ে উঠেছিল। দলের বেশিরভাগ সদস্য হিন্দু ছিলেন এবং তাদের বেশিরভাগ অংশই হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কংগ্রেস পার্টি হয়ে উঠেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বেশিরভাগ বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারা বিশ্ব থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের মুক্তির পরে তারা দেখেছিল যে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের ছোট্ট ধর্মীয় দল মুসলিম লীগ উপমহাদেশে একটি বড় নাম হয়ে গেছে। তারা মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্নের মাধ্যমে রাজের মুসলমানদের সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল।

ইতোমধ্যে ব্রিটিশরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি এবং রাজ্যে ক্রমবর্ধমান স্বাধীনতা আন্দোলনের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলো। তারা আস্তে আস্তে উপমহাদেশের অভ্যন্তরে তাদের শক্তির দখলটি হারাচ্ছিল। উপনিবেশ হিসাবে উপমহাদেশ চালানো ব্যয়বহুল ব্যাপার হয়ে উঠছিল। অতএব, তারা শেষ পর্যন্ত উপমহাদেশের বাসিন্দাদের স্বাধীনতার দাবি মেনে নিল।

পার্টিশনের এই তিনটি খেলোয়াড়ই তাদের স্বার্থপর কারণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে শত্রুতা ও শত্রুতার অনুভূতির জন্ম দেয়। একত্রে বছরের পর বছর ধরে পাশাপাশি থাকা সম্প্রদায়গুলি হঠাৎ একে অপরের থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন বোধ করতে শুরু করে। তারা তাদের মধ্যে বিশ্বাস হারাচ্ছিল। সহ-ধর্মবাদীরা অন্যান্য মতপার্থক্য সত্ত্বেও ভাই হয়ে ওঠে এবং অন্য ধর্মের সদস্যরা শত্রুতে পরিণত হয়।

বিভাগ সম্পর্কিত বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অভাব, দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং রাষ্ট্রীয়তা, গঠনতন্ত্র ও ভূমি বিভাগ সম্পর্কিত নীতিমালা, জড়িত পক্ষের স্বার্থপর স্বপ্ন এবং প্রেরণা, গুজব ছড়ানো, কথা এবং কাজের মধ্যে স্পষ্টতার অভাবের – সবকিছুর ফলস্বরূপ মারাত্মক রক্তপাত, জাতিগত শুদ্ধি এবং জনসংখ্যার স্থানচ্যুতি যা জড়িত কোনও পক্ষ দ্বারা প্রত্যাশিত ছিল না।

লেখক কারণগুলির সাথে ঘটনাগুলির ধারাবাহিক বিবরণ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। যারা এই সমস্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছিল তাদের চিত্রিত করার ক্ষেত্রেও তিনি একটি দুর্দান্ত কাজ করেছেন। তিনি মানুষের মানসিকতা, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সেই সময়ের সামগ্রিক ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

  

(এই বিভাগের লেখা ও মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত মতামতের সাথে ইয়ুথ পলিসি ফোরামের মতামতের সামঞ্জস্য নাও থাকতে পারে। আমাদের সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করা যেকোন ধারণা ও লেখার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।)

Leave a Comment

Scroll to Top