দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি: কারণ ও করণীয়

লিখেছেনঃ আরিফুল হাসান শুভ

ম্প্রতি খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের বাজার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমশ তা সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করছে। ফলে জনজীবন হয়ে উঠছে অতিষ্ঠ। মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া দ্রব্যের মধ্যে মূলত চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে।

অর্থনীতি অনুযায়ী, সাধারণত কোনো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় যখন এর চাহিদার অনুপাতে যোগান সীমিত থাকে। এছাড়া যেসব দ্রব্য আমদানি নির্ভর, সেগুলোর মূল্য বৃদ্ধির সাথে সম্পর্ক থাকে রপ্তানিকারক দেশে দ্রব্যটির চাহিদা ও যোগান, বাহ্যিক কোনো কারণে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, রপ্তানির উপর নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বিষয়ের।

উদাহরণ হিসেবে পেঁয়াজ ও ভোজ্য তেল নিয়ে আলোচনা করা যাক। বাজারে পেঁয়াজের বর্তমান মূল্য প্রতি কেজিতে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা আর প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের মূল্য ১৬০ টাকা।

ভারতের প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী এলাকা নাসিক ও ব্যাঙ্গালুরুতে অতিবৃষ্টির কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভারতে পেঁয়াজের দাম সামান্য বেড়েছে। এ খবরে বাংলাদেশে এর মূল্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বাৎসরিক ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর ৮০ ভাগ স্থানীয় উৎপাদন থেকে মেটানো সম্ভব হয়। ২০ ভাগ ঘাটতি পূরণের জন্য নির্ভর করতে হয় আমদানির উপর যার সিংহভাগ আসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে।

অপরদিকে, দেশের মোট চাহিদার ৯৫ শতাংশ ভোজ্য তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বিশ্বের শীর্ষ সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী দেশ হলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণ হলো উক্ত দেশগুলোতে উৎপাদন তথা রপ্তানি বেড়েছে, আর একইসাথে ডলারের বিপরীতে দেশগুলোর মুদ্রা শক্তিশালী হয়েছে। এছাড়া তারা রপ্তানিশুল্ক বাড়িয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে আমদানির ক্ষেত্রে ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাই স্থানীয় বাজারে বেড়েছে দাম।

আবার, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এক বছর যাবতই তেলের বাজার অস্থিতিশীল। বর্তমানে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ৮২.৫ মার্কিন ডলার। ফলে আমদানি নির্ভর দ্রব্যের পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে সরকারকে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে আমদানি নির্ভর দ্রব্যের উপর শুল্ক প্রত্যাহার ও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত দ্রব্যের জন্য বিকল্প আমদানি উৎস নিশ্চিত করতে হবে। যেমন, সম্প্রতি ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পর মায়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছে সরকার। এছাড়া জরুরি ভিত্তিতে দ্রব্যমূল্যে ভর্তুকি দিতে হবে।

বাজারে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কর্তৃক ভর্তুকি মূল্যে সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হয়ে থাকে, যাকে বলে ট্রাক সেল। এই কার্যক্রম প্রশংসনীয় তবে এক্ষেত্রে দৈবভাবে না দিয়ে পেশা ও পরিচয় দেখে যারা দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে যাদের নাভিশ্বাস,  তাদের নিকট দ্রব্য বিক্রয় নিশ্চিত করতে হবে। 

সামগ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় সরকারের নজরদারি আরও জোরদার করতে হবে। দেশের বাইরে মূল্য বৃদ্ধি একটি কারণ হলেও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা একে অজুহাত হিসেবে অপব্যবহার করে থাকে। ফলে বাজার হয়ে উঠে অস্থিতিশীল। এই খাতে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা কৃষক বা মাঠ পর্যায় থেকে দ্রব্যের বাজার পর্যন্ত আসার যাত্রায় মাঝপথে মূল্য বৃদ্ধির পেছনে অনেকাংশে দায়ী এই সিন্ডিকেট। সরকারকে এ ব্যপারে কঠোর হতে হবে।

বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সাধারণত খাদ্যশস্যের আমদানি নির্ভরতার হার ১৭.৮ শতাংশ।

দেশে নির্দিষ্ট কোনো দ্রব্যের মূল্য বিশেষ কারণে স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে কিন্তু যাবতীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির সতর্ক বার্তা বহন করে। বৃহৎ পরিসরে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি যেন হতে না হয় সেজন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমদানি নির্ভর দ্রব্যে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করতে হবে। এতে দেশেই উৎপাদনের প্রতি উৎসাহ বাড়বে, সেইসাথে কৃষক পাবে তার ন্যায্য ও কাঙ্ক্ষিত মূল্য। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পেঁয়াজ আমদানিতে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। 

অন্যদিকে, রপ্তানি ক্ষেত্রে বাজার বহুমুখীকরণ এখন চূড়ান্ত সময়ের দাবি। প্রায় এক দশক ধরে রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ যোগান দিচ্ছে আমাদের পোশাক শিল্প। একটি একক খাতের উপর এতো বেশি নির্ভরশীলতা দেশের অর্থনীতির জন্য ঝুকিপূর্ণ। এ থেকে বেরিয়ে এসে অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাত সমৃদ্ধ করতে হবে।

আরিফুল হাসান শুভ;

লেখক, সাংবাদিক ও অর্থনীতি শিক্ষার্থী, (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট)

সহযোগী সম্পাদক, ওয়াইপিএফ কন্টেন্ট ও বাংলা সম্পাদনা বিভাগ, ইয়্যুথ পলিসি ফোরাম

Scroll to Top