বিশ্লেষণ – শ্রীলংকায় গণআন্দোলন ও সরকার পতন

লিখেছেনঃ আমের মোস্তাক আহমেদ

জনগণের ধাক্কায় শ্রীলংকায় সরকার পতন। আপাতদৃষ্টিতে এমনটাই মনে হবে। কিন্তু পুরো বিষয়টা এতটা সরলরৈখিক নাও হতে পারে।
প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস চাইলেই জনগণ কর্তৃক এক সকালে দখল করে ফেলা যায় না। তাও রক্তপাতহীন ভাবে। সেই রাষ্ট্রে সরকারের প্রতি যত জনরোষই থাকুক না কেন। একটা পর্যায়ে অবশ্যই কারো না কারো না পক্ষ থেকে সিকিউরিটি ডিটেইলস আর সামরিক বাহিনীগুলোকে স্ট্যান্ডডাউন অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

এই কথাগুলো বললাম কারণ যে কোন গণআন্দোলনকেই অনেক বেশি রোমান্টিসাইজ করা হয় শুধুমাত্র “অর্গানিক” জনগণের আন্দোলন হিসেবে। গণআন্দোলনে অবশ্যই পলিটিক্যাল ব্যাকিং লাগে। এবং লাগে সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ। আর শ্রীলংকার মতো এমন ভৌগোলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ন রাষ্ট্রের রাজনীতিতে শক্তিশালী বিদেশী রাষ্ট্রদের ভূমিকা সবসময়ই থাকে। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে যেমন ভারত এবং চীন। তবে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস দখলে কোন কোন পক্ষ ভূমিকা রেখেছে সেটা জানা যাবে পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই।

উপরে বলা কথাগুলোর মাধ্যমে আমি এই আন্দোলনকে ছোট করতে চাই না। রাজাপাকসে ডায়নেস্টির দুর্নীতি থেকেও চোখ সরাতে চাই না। সরকারের প্রতি জনগণের আক্রোশও মিথ্যা ছিল না। বিশেষ করে বর্তমান অর্থনৈতিক ক্রাইসিসে এরকম আক্রোশ বিস্ফোরিত হবে সেটাই স্বাভাবিক।

তবে শ্রীলংকার বর্তমান ক্রাইসিসের পেছনে শুধুমাত্র রাজাপাকসেদের ভূমিকা ছিল সেটাও বলা যাবে না। যদিও গত দুই দশকে এই ডাইনেস্টিই বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায় ছিল। শ্রীলংকাকে গৃহযুদ্ধের চক্র থেকে উদ্ধার করা ওয়ারহিরো ফ্যামিলিও হচ্ছে এই ডাইনেস্টি। কিন্তু হিরো থেকে জিরো হওয়ার পেছনে যে পলিসিগুলো ভূমিকা রেখেছে, সেগুলো স্বার্থক হলে এই হিরো স্ট্যাটাস আরো বেশি পাকাপোক্ত হতো।

এই ক্রাইসিসের পেছনে একটি বড় ভূমিকা ছিল অর্গানিক ফার্মিং এর সিদ্ধান্ত গ্রহন। অর্গানিক ফার্মিং এর সিদ্ধান্তগ্রহনের পূর্বে দেশের প্রায় ৮০% ফুড সাপ্লাই নিজস্ব কৃষিখাত থেকেই হতো। এছাড়াও দেশের টোটাল এক্সপোর্টের প্রায় ২০% আসতো কৃষিখাত থেকে। এই হাই আউটপুট কৃষিখাতে সরকারের ভর্তুকিও ছিল অনেক। বিশেষ করে কেমিক্যাল সার ক্রয়ে সরকার ৯০% পর্যন্তও ভর্তুকি দিয়েছে। তবে ননঅর্গানিক ফার্মিং এর বাইপ্রোডাক্ট ছিল কিডনিরোগ। আর ক্রনিক কিডনি ডিজিজে শ্রীলংকা হটস্পট হয়ে উঠেছিল। এর ফলশ্রুতিতেই সরকার হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় অর্গানিক ফার্মিং এ শিফট করার। গোতাবায়া রাজাপাকসের ইলেকশন ক্যাম্পেইন প্রমিসও ছিল অর্গানিক ফার্মিং এ শিফট করার পলিসি। আর এর ফলেই ২০২১ এর এপ্রিলে একবারে পুরো কৃষিখাতকে অর্গানিক ফার্মিং এ পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেমিক্যাল সারে ভর্তুকিও প্রায় বন্ধ করে দেয়া হয়। শ্রীলংকার কৃষিখাত এর জন্য প্রস্তুত ছিল না।

প্রথমত, অর্গানিক সার তৈরির সময় পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, আউটপুট হয়েছে অনেক কম। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে যে প্রিমিয়াম প্রাইসিং আশা করেছিল তা পায়নি। এর ফলে এক্সপোর্ট তো দূরের কথা, আভ্যন্তরীনভাবেই খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। আর এই সিদ্ধান্ত এমন সময় নেওয়া হয়েছে যখন মহামারীর কারণে শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় বৈদেশিকমুদ্রা আয়খাত ট্যুরিজম একেবারেই বন্ধ।

আরেকটি বড় কারণ ছিল ডিপ ট্যাক্স কাট। ক্ষমতায় আসার পরপরই ইলেকশন প্রমিসের কারণে বিভিন্ন খাতে কর হার কমিয়ে আনা ছাড়াও ভ্যাট ১৫% থেকে ৮% এ নামিয়ে আনা হয়। আপাত দৃষ্টিতে জনগণের জন্য ভালো সিদ্ধান্ত মনে হলেও, মহামারীর ঠিক আগে নেওয়া এই পপুলিস্ট সিদ্ধান্তের কারণে সরকারের ঠ্যাক্স বেইসে আঘাত আসে। করদাতার পরিমাণও প্রায় ১৫ লক্ষ থেকে কমে প্রায় চার লক্ষে নেমে আসে। আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলো শ্রীলংকার রেটিং কমিয়ে দেয় যার ফলে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়ায় অসুবিধা তৈরি হয়। কর কমিয়ে আনার এই সিদ্ধান্ত বাজেট ডেফিসিট বাড়িয়ে দেয়। তার ওপর এক্সটার্নাল সোর্স থেকে ঋণ পাওয়ায় জটিলতা, মহামারীর কারণে রেমিট্যান্স কমে আসা, ট্যুরিজম সেক্টর স্থবির হয়ে যাওয়ার কারণে ফরেইন কারেন্সি রিজার্ভ বেশ দ্রুততার সাথে কমতে শুরু করে। খাদ্য আমদানি ও জ্বালানি আমদানিতে অনেক খরচ বেড়ে যায় কিছুটা অর্গানিক ফার্মিং এর ফেইলিউরের কারণে আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে।

শ্রীলংকার অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মূল কারণ যে দু’টি ১) অর্গানিক ফার্মিং পলিসি ও ২) ডিপ ট্যাক্স কাট, দু’টিই ছিল সরকারের ইলেকশন প্রমিস এবং পপুলিস্ট সিদ্ধান্ত। সফল হলে সরকারের ইমেজ আরও উজ্জ্বল হতো।

এছাড়া ১) মহামারী ও ২) ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল না কারণ এগুলো বৈশ্বিক প্রভাবক।

তবে নিয়ন্ত্রণ ছিল অপরিকল্পিত মেগা প্রোজেক্টে যেগুলোর পেছনে খরচের জন্য ফরেইন সোর্স মানে চীন থেকে ব্যাপক ঋণ নিয়ে জিডিপিতে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। আর ডেফিসিট বাজেট ম্যানেজমেন্টের ক্ষমতা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। দূর্ণীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের প্রভাবও পড়েছে। এখানে অবশ্যই সরকারের দোষ আছে।

ক্রাইসিসের কারণে মাহিন্দে রাজাপাকসের পদত্যাগের পর বিরোধীদল থেকে রানিল ভিকরামসিংহকে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করা হয় যদিও তাঁর দল থেকে এবার সংসদে মাত্র একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন (রাজাপাকসে এবার ক্ষমতায় আসার ঠিক আগেই এই দল ক্ষমতায় ছিল)। তাঁকে প্রধানমন্ত্রীত্ব প্রদানের কারণ হচ্ছে বিদেশী দাতাগোষ্ঠী ও প্রভাবশালী দেশগুলোতে তাঁর গ্রহনযোগ্যতা ও কানেকশন। শ্রীলংকা এখন যে ক্রাইসিসে আছে (বৈদেশিক মুদ্রা স্বল্পতা), তা থেকে মুক্তির জন্য দাতাসংস্থাগুলোর সাহায্য জরুরি। এই কারণে আইএমএফের সাথে কাজও চলছে। তিনি আবার এই লবি পয়েন্ট শক্তিশালী করতে মালদ্বীপের পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি ও বর্তমান সংসদ স্পিকার মোহাম্মদ নাশিদকে জাতীয় পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন কারণ পশ্চিমা বিশ্বে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাব আছে।

শ্রীলংকা এখন মূলত: ব্যাংকরাপ্ট রাষ্ট্র। এরকম একটি অবস্থায় বিদেশী ঋণ আনতে হলে পুরো দেশকেই লম্বা সময়ের জন্য শেকলে আটকাতে হবে। ট্যাক্স বাড়বে। খরচ কমাতে হবে। বাজেটিং এর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে হবে। অস্টেরিটি মেজার নিতে হবে। এগুলো জনগণের জন্য আরও খারাপ সময় নিয়ে আসবে। কিন্তু এরকম করা ছাড়া উপায়ও নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না ফাইন্যান্সিয়াল ডিসিপ্লিন স্থাপিত করে নিয়ন্ত্রণ আনা যায় অর্থনীতিতে।
কিন্তু এরকম একটি সময়ে রানিল ভিকরামসিংহের পদত্যাগ বা ইমপিচমেন্ট (যদি তিনি নিয়ম অনুযায়ী গোতাবায়ার পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি হন তাহলে তাঁকে ইমপিচ করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে) দাতা সংস্থাগুলোর মাঝে অস্থিরতা তৈরি করবে। কারণ আপাতদৃষ্টিতে শ্রীলংকায় এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো নেতা নেই। এই পরিস্থিতিতে দেশে যেই ক্ষমতায় আসুক, তাঁর পক্ষে হয়তো ভালো নেগোশিয়েশন সম্ভব হবে না। আবার তাঁর পেছনে যদি আসলেই ভারত বা চীনের সমর্থন থাকে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ারও সম্ভাবনা আছে। একই সাথে এই অর্থনৈতিক ক্রাইসিস মোকাবেলায় যে অপ্রিয় ও শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা পপুলার রিভোল্টে আসা সরকারের পক্ষে গ্রহন করা কঠিন হবে।

রাজনীতি, হোক বৈশ্বিক বা আভ্যন্তরীন, সবসময়ই নিয়ন্ত্রণের খেলা। আর এই নিয়ন্ত্রণ দুর্বল মুহূর্তে নেওয়া সবচেয়ে বেশি সহজ হয়। শ্রীলংকা এরকমই একটি দুর্বল মুহূর্তে আছে। এরকম ক্রাইসিস টাইমে তাই জাতীয় ঐক্য দরকার হয়। কারণ অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে অনেক বেশি। তা হজম করারও ইচ্ছা থাকতে হবে জনগণের। এরকম অবস্থায় ভিকরামসিংহের পদত্যাগ যেমন দাঁতা গোষ্ঠীকে দূরে ঠেলে দিতে পারে আবার রাজাপাকসেদের পতন দুর্বল একটি সরকারের জন্ম দিতে পারে।

তাই গণআন্দোলন মানেই যে সাফল্য আসবে শ্রীলংকায় সেটি ভাবা ভুল হবে। সাফল্য আনতে হলে দরকার হবে জাতীয় ঐক্যের। সেই ঐক্যে রাজাপাকসেদের জায়গা না হলেও, এমন মানুষ নেতৃত্বে থাকতে হবে যাঁর পক্ষে জনগণকে মানানো, কঠিন সিদ্ধান্তগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী এবং বাণিজ্যিক পার্টনারদের শান্ত রাখা সম্ভব হবে।

এরকম কোন নেতা শ্রীলংকায় আসবে কিনা সময়ই বলে দেবে।

Scroll to Top