শ্রীলংকা-লেবানন পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ

লিখেছেনঃ আনিসুর রহমান কিরন

লেবানন নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে বা করার উপক্রম হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ধুকছে। এসব দেখে আমাদের দেশের অনেকে আতঙ্কে ভুগছেন। কেননা, লেবানন-শ্রীলঙ্কার মতো আমাদেরও বাণিজ্য ঘাটতি বেশী, তাদের মতো করে আমাদের মাথার উপরেও ঋণের বোঝা রয়েছে।

কিন্তু আশার ব্যাপার হলো, নানারকম ফ্যাক্টস পর্যালোচনা করে দেখেছি যে, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্ভাবনা করার মতো খারাপ অবস্থানে নেই। এমনি এমনি বলছি না। প্রয়োজনীয় তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করলে আমরা তা সহজেই বুঝতে পারবো।

শুরুতে বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে আলাপ করা যাক। চলমান ২০২১-২২ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের ঋণ ৫,৩৮৫.৮ কোটি ডলার। অর্থবছরের শুরুতে জিডিপি’র নিরিখে আমাদের অর্থনীতির আকার ৪০,৯০০ কোটি ডলার। ফলে আমাদের উপর চেপে বসা ঋণের পরিমান হচ্ছে জিডিপির ১৩.১৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের মতে, কোনো দেশের জন্য বৈদেশিক ঋণের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ঐ দেশের জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। তাই বলা যেতে পারে, এদিক থেকে আমাদের অবস্থান বেশ নিরাপদ। বিশ্বসেরা ক্রেডিট রেটিং সংস্থা Moody’s এবং S&P (Standard & Poor’s) বাংলাদেশকে যথাক্রমে Ba3 এবং BB- ক্যাটাগরিতে রেখেছে। এসবের মানে হলো, আমাদের ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা যথেষ্ঠ ভালো। বাংলাদেশ

এখন পর্যন্ত বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণ ঠিকমতো পরিশোধ করে এসেছে। সর্বশেষ অর্থবছরগুলোতে ঋণ পরিশোধের নমুনা-
*২০১৬-১৭ অর্থবছরঃ ১১৪.৪ কোটি ডলার
*২০১৭-১৮ অর্থবছরঃ ১৪০.৯ কোটি ডলার
*২০১৮-১৯ অর্থবছরঃ ১৫৯.৩ কোটি ডলার
*২০১৯-২০ অর্থবছরঃ ১৭৩.৪ কোটি ডলার
*২০২০-২১ অর্থবছরঃ ১৯১.৪ কোটি ডলার

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১০৪ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। সব মিলিয়ে এই অর্থবছরের বাজেটে ২০৯ কোটি ডলার পরিশোধ করার কথা ঘোষনা করা হয়েছে (28 January’22, The Daily Star)।

পক্ষান্তরে, শ্রীলঙ্কার জিডিপির আকার ৮১ বিলিয়ন ডলারের কম। ২০২২ সালের শুরুতে তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমান ৪,০০০+ কোটি ডলার (প্রকৃত সংখ্যাটি অজানা)। অর্থাৎ, শ্রীলঙ্কার ঋণের পরিমান তাদের জিডিপির ৫০ শতাংশ, যা সহনীয় মাত্রার তুলনায় অনেক বেশী। Moody’s এর দৃষ্টিতে তাদের রেটিং Caa2 এবং Standard & Poor’s (S&P) এর হিসেবে রেটিং CCC-; সোজা কথায় Downgrade অবস্থা। এই রেটিং দেখাচ্ছে যে, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির পক্ষে তাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা খুবই কম।

আরো কথা আছে। শ্রীলঙ্কার ঋণের অর্ধেক সভেরেইন বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে সংগৃহীত হয়েছে। সভেরেইন বন্ডের মেয়াদ সাধারনত ১০ বছরের কম হয়, সুদহারও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী হয়। এসব বন্ডের ক্ষেত্রে কোনো গ্রেস পিরিয়ড থাকে না। অর্থাৎ, একেবারে প্রথম দিন হতে সুদ দিতে হয়।
বাংলাদেশের ঋণের সবই মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি। আমাদের বেশীরভাগ ঋণ বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আইএমএফের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। এর বাইরে অবশিষ্ট ঋণ নেয়া হয়েছে জাপান, চীন, রাশিয়া, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও ভারতের কাছ থেকে। এসব ডোনার এজেন্সি থেকে নেয়া ঋণের সুদহার খুব কম। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ১০-১২ বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকে। গ্রেস পিরিয়ড হলো, যে সময়ে কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হয় না। এই গ্রেস পিরিয়ডের পর ঋণ শোধের জন্য ২০-৪০ বছর সময় থাকে।

আমাদের দেশের নেয়া ঋণগুলোর বেশীরভাগই বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। নিচে উল্লেখ করা প্রকল্পগুলোর জন্য প্রচুর বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছে বা হচ্ছেঃ

*রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (রাশিয়া ১,১৩,০৯২ কোটি টাকা; ২৮ বছরের মধ্যে ৪% সুদসহ পরিশোধ করতে হবে; ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (জাপান ৪৩,৯২১ কোটি টাকা; ০.০১% সুদসহ ৩০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে; ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প (চীন ২১,০৩৬ কোটি টাকা; ২০ বছরের মধ্যে ২% সুদসহ পরিশোধ করতে হবে; ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*মেট্রোরেল MRT-6 (জাপান ১৭,৯৪৪ কোটি টাকা; ১৬,৫৯৫ কোটি টাকা ০.০১% সুদসহ এবং ১,৩৫০ কোটি টাকা ০.৭% সুদসহ ৩০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে; ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র (চীন ১.৯৬ বিলিয়ন দলার; ১৫ বছরের মধ্যে ২% সুদসহ পরিশোধ করতে হবে; ৪ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩ (জাপান ১৬,১৪১ কোটি টাকা; ৩০ বছরের মধ্যে ০.৬৫% সুদসহ পরিশোধ করতে হবে; ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ (এডিবি ১৩,১১৫ কোটি টাকা; ২৫ বছরের মধ্যে ২% সুদসহ পরিশোধ করতে হবে; ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু (জাপান ১২,১৪৯ কোটি টাকা; ৩০ বছরের মধ্যে ০.৬৫% সুদসহ পরিশোধ করতে হবে; ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*টাঙ্গাইল-রংপুর চার লেনের মহাসড়ক (এডিবি ১১,৬২৫ কোটি টাকা; ২৫ বছরের মধ্যে ২% সুদসহ পরিশোধ করতে হবে; ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড)

*রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (ভারত ১.৪৯ বিলিয়ন ডলার)

বৈদেশিক ঋণের সর্বশেষ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আমাদের অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে আমাদের মাথাপিছু ঋণ ২৯২ ডলার। প্রতিশ্রুতি পাওয়া ৯৫৯০.৮৩ কোটি ডলারের মধ্যে আমরা হাতে পেয়েছি ৪,৯৪৫.৮ কোটি ডলার (২০২১-১২২ অর্থবছরের ৪৪০ কোটি ডলার বাদে) এবং পাইপলাইনে ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে ৪,৬৪৫.০৩ কোটি ডলার। চলমান অর্থছরে ১২৮৯ কোটি ডলার পাওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে। চলমান প্রকল্পগুলো চালু হলে অর্থনীতিতে গতিসঞ্চারের ফলে সরকারের আয় বাড়বে। আশা করা যায়, তখন এগুলো শোধ করে দেয়া খুব কঠিন হবে না (১৫ সেপ্টেম্বর’২১, দ্য ডেইলি স্টার)।

আমাদের বৈদেশিক ঋণের পরিস্থিতি হচ্ছে এরকম। খুব একটা বিপজ্জনক অবস্থা বলা যাবে না। তবে সকলের চোখের সামনে আমাদের একটা বড়ো সমস্যা তৈরী হতে যাচ্ছে। সেদিকে এবার একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন।

আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয় (জুলাই-মার্চ) মাসে আমরা রপ্তানি করেছি ৩,৮৬০ কোটি ডলারের পণ্য। একই অর্থবছরের প্রথম আট (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মাসে ৫,৯৪৫ কোটি ডলারের পন্য আমদানী করার জন্য এলসি খোলা হয়েছে। এই বিশাল পার্থক্য খুবই উদ্বেগের। রেমিটেন্স দিয়ে কিছুটা ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। যেমন, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়কালে ১,৫২৯.৮৫ কোটি ডলারের রেমিটেন্স দেশে এসেছে। তারপরও, আমদানী-রপ্তানির এই ঘাটতি বিপজ্জনক মাত্রায় পৌচেছে (৬ এপ্রিল’২২, বণিক বার্তা; ৩ এপ্রিল’২২, অর্থসূচক)।

আরেকটি সূচক খানিকতা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বাজেটের ঘাটতি মোকাবেলায় সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রচুর ঋণ করছে। যেমন, ব্যাংকিং সেক্টর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২,৬৩,৫১৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এবং বন্ড ছেড়েও অনেক টাকার সংস্থান করেছে।

এসবের সুদহার চড়া, কমবেশী ৯ শতাংশ। ফলে আমাদের বাজেটের একটা বড়ো অংশ (১১ শতাংশ) শুধু এসবের সুদ পরিশোধ করতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। একই সাথে, ব্যাংকিং সেক্টরের তারল্য সরকারের কাছে চলে যাওয়ায় বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের যোগান দিতে ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ ঋণের বোঝা আমাদের দেউলিয়া করে ফেলতে না পারলেও পরিস্থিতি জটিল করে ফেলছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের কৌশলী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, প্রচুর সতর্কতার সাথে ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলো বাছাই করতে হবে। বাছাইকৃত প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।

ফিচারড ইমেজ কার্টেসিঃ Livemint

Scroll to Top