শিক্ষকতা ও রাজনীতি 

এক যুগেরও আগের কথা। আমার এক বন্ধু তখন একটি সরকারী মেডিকেল কলেজে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে (পরবর্তীতে বন্ধুটি ঐ কলেজে ছাত্র সংগঠনটির জিএস হয়েছিল)। ওকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কেন সে ছাত্র রাজনীতি করে? উত্তর দিয়েছিল হলে শান্তিতে থাকার জন্য। ওর বক্তব্য ছিল যে প্রতিদিন যেন ওকে সব পক্ষই মিছিল মিটিং এ টেনে নিয়ে না যায় সেটা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ ও নিয়েছিল। পরবর্তীতে অবশ্য পরীক্ষায় পাশ করা থেকে শুরু করে আলাদা সুযোগসুবিধা, হলে ভালো সিট পাওয়া, পার্টি ফান্ডের টাকার ভাগ পাওয়া এ সবই সুযোগ-সুবিধার লিস্টে এসেছিল। ছাত্র রাজনীতির কথা শুনলে প্রথমেই ছাত্র-ছাত্রীদের বিশাল মিছিলের চেহারা মাথায় আসে। কিন্তু এগুলোর পেছনে যে শিক্ষকদের রাজনীতি-রাজনীতি খেলার একটা বড় অবদান থাকে, সেটা চোখ এড়িয়ে যায়। পার্টি ফান্ডের টাকার কথাই বলি। কোন অনুষ্ঠান করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোকে যে ফান্ড দেয়া হয়, তার একটি বড় অংশ শিক্ষকরা খেয়ে ফেলে। এ ব্যাপারে একটি ঘটনা শুনেছিলাম অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যেখানে অধ্যক্ষ আশি ভাগ টাকা হজম করে ফেলেছিল। সে অবশ্য অধ্যক্ষই হয়েছিল প্রায় চল্লিশ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে। এর বদলে হজম করেছিল প্রায় দুই কোটি টাকা! 500% রিটার্ন!

ছাত্র রাজনীতির কুৎসিত রূপটা জিইয়ে রাখার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন কিছু শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে পরিষ্কার হায়ারআর্কি আছে। কিন্তু সেই হায়ারার্কির সুবিধা নিয়ে ছাত্র তোষণে মেতে থাকে কিছু শিক্ষক। কিন্তু তাঁদের ব্যপারে প্রায় কিছুই শোনা যায় না। যে শিক্ষকদের দায়িত্ব ছিল নিরাপত্তা দেয়ার, তাঁরাই ঠেলে দিচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের এক অন্ধকার জগতে!

আর এখনতো প্রাক্তন ছাত্র-রাজনীতির ক্যাডারগণই প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষক হিসেবে ঢুকছেন। ওনাদের শিক্ষক হওয়ার মোটিভেশনটাই বা কি? রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যে পদটা নষ্ট করছেন সেখানটায় হয়তো জায়গা করে নিতে পারতো আরেকজন আব্দুল মুক্তাদির বা গোভিন্দ চন্দ্র দেভ। তাঁদের জ্ঞানপিপাসা আর আদর্শ শিক্ষকতায় জীবন বদলে যেত অনেক শিক্ষার্থীর। এখন কারা আছেন শিক্ষকতা পেশায়? কেন তরুণ শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতা এখন আর প্রসারিত নয়? কি পড়ান তাঁরা? কি শেখান? পথ কি দেখান? নাকি বইয়ের পৃষ্ঠা কোনমতে উল্টিয়েই দায়িত্ব খালাস বলে মনে করেন?

সুবিধাবাদী আর ভোগবাদী চেতনায় ডুবে থাকা কোন মানুষ, যাঁর মূল উদ্দেশ্য থাকে চেয়ার ব্যবহার করে টাকা বানানোর, তাঁদের পক্ষে কি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের জোয়ার তোলা আদৌ সম্ভব? 

সুবিধাবাদী আর ভোগবাদী চেতনায় ডুবে থাকা কোন মানুষ, যাঁর মূল উদ্দেশ্য থাকে চেয়ার ব্যবহার করে টাকা বানানোর, তাঁদের পক্ষে কি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের জোয়ার তোলা আদৌ সম্ভব? 

একটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে একটি সভ্যতার সূতিকাগার। রাষ্ট্রের প্রতিটি কোণ থেকে তরুণী তরুণরা পড়তে আসে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে শিক্ষা তাঁরা পাবেন, তাই তাঁরা ছড়িয়ে দেবেন নিজেদের অঞ্চলে। অথবা অন্য রাষ্ট্রে। একটি রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেয়ার আর বিশ্ব নাম উজ্জ্বল করার এর চাইতে কার্যকর মাধ্যম আর কি আছে! 

কিন্তু আমরা তাতে ব্যর্থ হয়েছি। আর আমাদের অনবরত টিটকারি মেরে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী কিছু বেসিক বিলো-স্ট্যান্ডার্ড ফ্যাক্টরি।

Author: Aamer Mostaque Ahmed
Author bio: কর্মকর্তা, ডিএফআইডি

Leave a Comment

Scroll to Top