বিশ্ব পরিবেশ দিবসঃ নীরব ঘাতকের সরব উপস্থিতি

লিখেছেনঃ আফরিনা আসাদ

রাজপথে ছুটে চলা হাজারো বাস/ট্রাক থেকে শুরু করে ঘরের জেনারেটর, কিংবা সভা সম্মেলন, মাইকিং থেকে শুরু করে বনভোজন আর বিয়ে, আদতে ভিন্ন হলেও যে দিকটি এসব কিছুকে এক সুতোয় গাঁথে তা হল – শব্দের তীব্রতা। এ যেন তীব্র হতে তীব্রতর হওয়ার অঘোষিত প্রতিযোগিতা। কেউ কান চেপে, কেউ হেডফোন লাগিয়ে আরো তীব্র অথচ মধুর শব্দে, আর কেউ নিয়তি ভেবে স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ গুন মাত্রায় শব্দ দূষণের দিনগুলি পার করছি – নিঃশব্দে!

অতীব সরব এই নীরব ঘাতক নীরবে শরীরে ভয়ানক ক্ষতি সাধন করছে। ওয়ার্ল্ড হেল্‌থ অর্গানাইজেশন বলে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৭ কোটি মানুষ, অর্থাৎ ১০ জনের মধ্যে ১ জন মানুষ, শ্রবনশক্তি হ্রাস জনিত সমস্যায় ভুগবে। তারা আরো জানায় বিশ্বের শ্রবনশক্তি হ্রাসপ্রাপ্ত মানুষদের মধ্যে ৮০% নিম্ন বা মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বাস করে, বলা বাহুল্য বাংলাদেশ এর মধ্যে একটি। এর উদাহারণ দেখতে পাচ্ছি আমরা ইতোমধ্যে। শুধুমাত্র ঢাকাতেই ৫০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে শব্দ দূষণের প্রভাবে। দীর্ঘমেয়াদী শ্রবণ সমস্যা, হৃদরোগ, অকাল মৃত্যু, স্ট্রোক, মানসিক সমস্যা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি নানান সমস্যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ এই শব্দ দূষণ। শুধু তাই নয় শিশুদের উপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাদের শেখার অগ্রগতিতে কিংবা শ্রবনশক্তিতে চিরতরে বিরূপ প্রভাব ফেলে শব্দ দূষণ। এমনকি পশু পাখি থেকে কীটপতঙ্গের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ভয়ানক প্রভাব এর। লাখো প্রাণির জীবন দুর্বিষহ করে তোলা এই কারণটি প্রায় সময় রয়ে যায় অগোচরে, কিংবা খুব বেশি হলে পাঠ্য বইয়ের আড়ালে। শব্দও যে দুষণ করা যায়, তীব্র শব্দ মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, ২০২১ সালেও কারও কারও জন্য তা এক নতুন তথ্য। হোক সে রাত কিংবা দিন, অন্যের সমস্যা অগ্রাহ্য করে অসহনীয় মাত্রায় শব্দ তৈরি করাটা কি যৌক্তিক? মানুষের ও পশুপাখির জীবন ঝুঁকিতে ফেলে শব্দ তৈরি করা কি স্বাভাবিক করে ফেলছি আমরা? শুধু কি ঢাকাবাসীর জীবনের চিত্র এই শব্দ দূষণ? এর প্রতিকার কি, কিইবা ভাবছে দেশবাসী?

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ মতে আবাসিক এলাকার শব্দের মানমাত্রা ৪৫-৫৫ ডেসিবেল(শব্দের তীব্রতা পরিমাপের একক), অথচ ২০১৮ সালে প্রকাশিত পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে ঢাকা শহরে আবাসিক এলাকার মধ্যে শাজাহানপুরে সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা লিপিবদ্ধ করা হয় ১২৮; যা নির্ধারিত মাত্রার প্রায় তিনগুন। একই চিত্র বানিজ্যিক, শিল্প কিংবা মিশ্র এলাকায়। শুধু তাই নয় ৮ টি বিভাগীয় এলাকায় চালানো জরিপটিতে দেখা যায় দেশের সব শহরের চিত্র প্রায় অভিন্ন। এমনকি “নীরব” এলাকা নামে চিহ্নিত মহাখালীতে সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা পাওয়া যায় ১১০, যা মানুষের স্বাভাবিক শ্রবন মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণের ও বেশি। অর্থাৎ নীরব কিংবা বানিজ্যিক কোন এলাকাতেই মানা হচ্ছেনা শব্দ সীমার ন্যূনতম আইন। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিনিয়ত ৯০ ডেসিবেলের ওপরে শব্দ মানুষের শ্রবনশক্তি চিরতরে হ্রাস ঘটাতে পারে। মানবসৃষ্ট অতিরিক্ত শব্দ সরাসরি ক্ষতি করতে পারে পশু পাখি, কীটপতঙ্গের বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষমতাকে। 

সাংখ্যিক মানের কাটখোট্টা চিত্র থেকে এবার আসা যাক, জনগণ কি ভাবছে। আমরা কি এই আদৌ বিচলিত? পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপমতে, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে ৪৫% এর বেশি মানুষ শব্দদূষণের বিধিমালা সম্পর্কে অবহিত নন, উপরন্ত ৯০% এর বেশি  মানুষ জানালেন আইনের কোন বাস্তবায়ন হতে দেখেননি। অর্থাৎ, “নীরব ঘাতক” কে প্রতিনিয়ত সহ্য করা হচ্ছে নীরবেই। অথচ এ ব্যাপারে সরব হওয়া সবচেয়ে জরুরী। জনগণের মতে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ কমাতে পারে জনদুর্ভোগ। কি বলছে আইন? শব্দ দূষণের বিধিমালা অনুযায়ী, দূষণকারীকে সর্বনিম্ন এক মাস হাজত কিংবা ৫ হাজার টাকা কিংবা উভয় এবং সর্বোচ্চ ৬ মাস হাজত কিংবা ১০০০০ টাকা কিংবা উভয় ভোগ করতে হতে পারে। কিন্তু জনমত অনুযায়ী আইন থাকলেও প্রয়োগ কিংবা জ্ঞান একেবারেই কম। রাতারাতি স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। 

আশার কথা হল, শব্দ দূষণের হ্রাস ঘটলে এর সুফল মিলতে পারে রাতারাতি।  বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, লকডাউনে শব্দ হঠাৎ কমে যাওয়ায় বিজ্ঞানীরা সান ফ্রান্সিস্কোতে পাখিদের সুরের ব্যাপক তারতম্য লক্ষ করেছেন। সেখানকার পশুপাখির জীবনযাত্রা রাতারাতি বদলে যায়। অর্থাৎ মানবসৃষ্ট শব্দের ভুক্তভোগী মানব পশু পাখি প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশু গুলো হলেও এর সমাধানটা শুধুই মানুষ এনে দিতে পারে। এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ যেমন দরকার তেমনই দরকার আইন নিয়ে, ক্ষতি নিয়ে সচেতনতা। হোক তা ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা বনভোজনের,   শিল্পকারখানা কিংবা বাসা বাড়ি, সচেতনতা যেন আরেকজন নয় নিজেদের মাধ্যমেই, নিজেদের এলাকা থেকেই ক্ষুদ্র উদ্যোগে শুরু হয়। শব্দ নিয়ে শব্দ হোক সর্বত্র, আমাদের হাত ধরেই কমে আসুক লাখ লাখ মানুষ ও পশুপাখির দুর্বিষহ জীবনের সমাপ্তি। 

আফরিনা আসাদ

অ্যাসোসিয়েট, 

বাংলা এডিটোরিয়াল, 

ইয়ুথ পলিসি ফোরাম

Leave a Comment

Scroll to Top