আরও বাক, আরও ভাষাঃ ঢাকাইয়া ভাষার ইতিহাস ও পরিচয়

কথিত আছে, ইংরেজ আমলে ঢাকাই নবাবেরা প্রতি রমজানের শেষ রোজার দিন আয়োজন করে ঈদের চাঁদ দেখার ব্যবস্থা করতেন। শাওয়ালের প্রথম চাঁদের ছায়া আকাশের এক কোণে প্রতীয়মান হতে দেখা গেলেই বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী এই নগরীতে শুরু হয়ে যেতে ঈদের উৎসব। পুরান ঢাকাইয়া ঈদের চান রাইত শব্দটির উৎপত্তি এই থেকে।


ঢাকাইয়া ভাষা বা কুট্টি ভাষার বিকাশ ও প্রচলন হলো অন্তত চারশো বছরের একটি সংস্কৃতির ইতিহাস যার পরতে পরতে মিশে আছে রাজা বাদশাহদের গল্প, ভিনদেশি মানুষের আগমনের গল্প আর সহজ সরল জীবনযাপনের মাঝে উৎসব উদযাপনের গল্প।

১৬১০ সালে মুঘল সুবেদার ইসলাম খান বাংলা বিজয়ের পর ঢাকাকে এই অঞ্চলের রাজধানী ঘোষনা করেন এবং বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী এই নগরীর নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। বাংলার রাজধানী হবার পর থেকেই এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক গুরুত্ব ভূ-ভারতবর্ষে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আর প্রকৃতির আশীর্বাদে পুষ্ট এই বাংলা অঞ্চলের কৃষি ফসলের নজির তো আবুল ফজলের আইনি-আকবরের খাতিরে জগৎবিখ্যাত।
উল্লেখ্য ১৬১০ হতে ১৮৪৩ পর্যন্ত যতবারই কোনো সুবেদার বা নায়েবে নাজিম ঢাকায় দিল্লী হতে দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন তাদের সাথে সাথে এই অঞ্চলে পাড়ি দিয়ে এসেছেন তাদের কর্মচারীরা যারা স্ব স্ব প্রতিনিধিদের বিদায়ের পরেও স্থায়ীভাবে টিকে গিয়েছেন এই ঢাকায়। ফলে এই ভিনদেশিদের ভাষার উর্দু ও ফারসি শব্দাবলি অবলীলায় প্রবেশ করে ঢাকাবাসীদের কথাবার্তা বা বাতচিতে।

তবে ঢাকাইয়া ভাষাকে কেনো কুট্টি ভাষা বলা হয় এই ইতিহাসটুকু জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে সতেরো শতাব্দীতে। ১৭৬২ সালে ঢাকায় সংগঠিত গুরুতর দুর্ভিক্ষে ঢাকার মধ্যাঞ্চল থেকে একশ্রেণীর শ্রমিক এসে বসবাস শুরু করে ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায়। এই সকল শ্রমিকদের প্রধান কাজ ছিলো ঢেঁকি ছেঁচে চাল বের করা করা। এই কাজটিকে আরেকভাবে বলা হয় ধান কুটা। পাশাপাশি এই শ্রমিকেরা ঢাকায় বসবাসরত জমিদারদের দালানকোঠা তৈরীর জন্য ইট ভাঙার বা কোটার কাজ করতো। এই পেশা থেকেই তাদের গোষ্ঠীর নাম হয় কুট্টি এবং ভাষাকে বলা হয় কুট্টি ভাষা।

আঠারো শতকের মধ্যভাগে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকায় চাল আমদানী করতে আসলো মধ্য ভারতের ব্যবসায়ী ও মাড়োয়ারি মহাজনেরা। পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা বিপুল পরিমাণ চাল ঢাকায় এনে ঢেঁকিতে ভানতে হতো বা কোটা হতো। ধান ভানতে শ্রমিকের প্রয়োজন পড়তো অনেক। আর এই কাজের জন্য ঢাকার আশপাশ থেকে প্রচুর শ্রমিকেরা আসতো। ধান কোটার সূত্রেই এই শ্রমিকেরা ধোলাইখাল ও এর আশেপাশের অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কালের বিবর্তনের তাদের বসবাসের এই অঞ্চল গুলোই হয়ে উঠে ঢাকাইয়া কুট্টি অঞ্চল আর এর বসবাসকারী বং ভাষাভাষীরা ঢাকাইয়া কুট্টি।

পুরান ঢাকার ধোলাইখালসহ ফুলবাড়িয়া, নাজিরাবাজার, বংশাল, নয়াবাজার, মাহুতটুলি, দেওয়ানবাজার, চকবাজার, বেগমবাজার, সাতরওজা, মৌলভীবাজার, মুঘলটুলি, ইসলামপুর, কলতাবাজার, কসাইটুলি, উর্দু রোড, খাজে দেওয়ান, লালবাগ, তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, পাটুয়াটুলি, বাংলাবাজার, ফরাশগঞ্জ, গ্লোরিয়া, লক্ষ্মীবাজার, নারিন্দা, মৈশুন্দি, মদনমোহন বসাক রোড, নবাবপুর, ওয়ারী, বনগ্রাম, হাটখোলা, টিকাটুলি, কায়েতটুলি, নবাবগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় এখনো বংশানুক্রমিকভাবে বসবাস করে ঢাকাইয়ারা।

তাদের নিজস্ব ভাষা ও বাচনভঙ্গী, জীবনযাপন, খাবার-দাবার এবং উৎসব পার্বনে রয়েছে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী স্বকীয়তা। সময়ের সাথে সাথে এইদেশের অনেক সংস্কৃতিই আধুনিকতার সংস্পর্শে বদলে গেলেও আদি ঢাকার প্রতি গলি, মহল্লা, পঞ্চায়েত এখনো ধরে রেখেছে নিজেদের বংশানুক্রমিক ধারা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা শহীদুল জহিরের লেখালেখির যারা নিয়মিত পাঠক ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা তাদের কাছে খুবই পরিচিত আর যারা এখনো এই দুই মহারথীর লেখা পড়েননি কিংবা কখনোই ঘুরে দেখার সুযোগ হয় নাই সুবা বাংলার এই রাজধানী তাদেরকে বলি, “আমাগো এই পুরান ঢাকায় ব্যাবাক মানুষ থাকে। আমাগো চিপা চিপা গল্লি আর অনেক খাওনের দোকান। অতিথি কেউ ঘুরবার আইলে আমরা হগলে তাগোরে ম্যামানদারি করি। আয়া পড়েন একদিন। গরম গরম নান্নার বিরিয়ানী খায়া যাইবেন আর দেইখা যাইবেন আমাগো, আপনেগো এই দ্যাশের ব্যাবাক মাইনষের এই টুকরা পুরান ঢাকাটা।

কন্টেন্ট : মোহাম্মদ সিফাত
ক্রিয়েটিভঃ ওয়াহিব অমিও

Leave a Comment

Scroll to Top