আরও বাক, আরও ভাষাঃ চাঁটগাঁইয়া ভাষার ইতিহাস ও পরিচয়

জনশ্রুতি আছে যে একবার প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন,”বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে “। তবে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লক্ষ ভাষাভাষীর এই চাটগাঁইয়া ভাষা এর ভিন্নধর্মী বাচনভঙ্গি আর বিচিত্র শব্দভান্ডারের জন্য জন্ম দিয়েছে এক বিতর্কের- এটি কি আঞ্চলিক ভাষা, উপভাষা, নাকি বাংলা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ভাষা?

চাঁটগাঁইয়া বা চিটাইঙ্গার উৎপত্তির ইতিহাসের দিকে যদি ফিরে তাকাই, তবে জানা যায় এটি মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্যের উপশাখা বাংলা-অসমীয় এর সদস্য। সিলেটি,রোহিঙ্গা, বাংলা, অসমীয়া,ওড়িয়া,বিহারি এ ভাষার সমগোত্রীয় ভাষা। অন্যান্য বাংলা-অসমীয় ভাষার মতই পালি ভাষাকে চাঁটগাঁইয়ার পূর্বসূরী বলে বিবেচনা করা হয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বহুকাল ধরেই ছিল আরব, ফারসি ও তুর্কি বণিকদের যাতায়াত। এছাড়া ইউরোপীয়দের মধ্যে ছিল পর্তুগিজ ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ ভাষায় বাংলার চেয়ে অধিক পর্তুগিজ,আরবি আর ফারসি শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় চট্টগ্রামের ভাষায় রয়েছে ৩৬ টি ব্যঞ্জনধ্বনি ও ৭ টি স্বরধ্বনি যার প্রত্যেকটির অনুনাসিক রূপ আছে। এ ভাষা ব্যবহারেও রয়েছে সতর্কতার প্রয়োজন, উচ্চারণের সামান্য হেরফের হলে অর্থ পরিবর্তন হতে পারে ( যেমন “আর” অর্থ এবং, “আঁর” অর্থ আমার)। তবে এ ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই, পূর্বে আরবি ও বর্তমানে বাংলা হরফ ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাহিত্যের দিক থেকে চাঁটগাঁর ভাষা বেশ সমৃদ্ধ। এ ভাষায় রচিত হয়েছে অজস্র গান যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- মধু হই হই বিষ হাওয়াইলা, যদি সুন্দর এক্কান মন ফাইতাম, ও ভাই আঁরা চাঁটগাইয়া নওজোয়ান প্রভৃতি। যদিও এ ভাষার লিখিত কোনো রূপ আবিষ্কৃত হয়নি, তবে বাংলা হরফে লেখা বেশ কিছু উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় যেমন-
” এত বড় ভিংছা জাতি
বসত রাজ্য শেষ
মাইনসে মানুষ বেচি খায়
এক আচানক দেশ”

এছাড়াও আলাওল, দৌলত কাজী, দৌলত উজির, সাবরিদ খান প্রমুখের লেখায় চাঁটগাঁইয়া শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। যেমন আলাওলের পদ্মাবতীতে আমরা দেখতে পাই-
পুছ(জিজ্ঞাসা করা)- শুক সম্বোধিয়া নৃপ করিল পুছার
ছাপাই( লুকানো) – পরম যতনে শুক রাখিল ছাপাই
বাঝা (আবদ্ধ /আটকে রাখা)- আহার দেখিয়া যেন পক্ষীমনে বস।
পশ্চাতে বাঝিলে ফাঁন্দে বড়ই কর্কশ।

তবে সমৃদ্ধ এই ভাষাও আজ হারিয়ে যাচ্ছে যথাযথ চর্চার অভাবে। এথনোলগ ( Ethnologue :Languages of the World) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ভাষভাষী জনগোষ্ঠীর হিসেবে সেরা ১০০ টি ভাষার মধ্যে চাঁটগাঁইয়া বুলির অবস্থান ছিল ৬৭ তম যা ২০২০ এ-র প্রতিবেদন অনুযায়ী নেমে দাঁড়িয়েছে ৮৮ তে।

কন্টেন্ট : তিষা সিকদার।
ক্রিয়েটিভ : ওয়াহিব অমিও।

Leave a Comment

Scroll to Top