আরও বাক, আরও ভাষাঃ খুলনার আঞ্চলিক ভাষার এবং তার পরিচয়

বয়স আমার বেশি না ওরে টুকটুকির মা, খালি চুল কয়ডা পাইহে গেছে বাতাসে…’- যে গানডা আলের এক গাইওক গাউয়ার পর গানডা হঠাৎ কোইরে জনমানুষির মুখি মুখি চোইলে আইছে, সেইডে যে খুলনার মাটির তা কি জানেন? “আরও বাক, আরও ভাষা” সিরিজের আজকের পর্বে সেই খুলনাবাসীর মুখির ভাষা নিয়ে ল্যাকপো।

আঞ্চলিক ভাষায় যে মায়া থাকে, ঘরে ফেরার যে টান থাকে, সেই টান, সেই মায়া ভদ্রলোকের ভাষায় কোথায়! আমাদের এই দেশ ভরা তেমন বিভিন্ন অঞ্চলের হরেকরকম ভাষায়, খুলনা-ই বা সেই বৈচিত্র্য থেকে বাদ থাকবে কেন! খুলনা বিভাগে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তেমন বসবাস না থাকায় এ বিভাগের অধিবাসীদের মুখের ভাষা মূলত বাংলাই। তবে সেই বাংলারও রয়েছে রকমফের। সারাদেশে প্রচলিত ভাষার বোধ হয় এই অঞ্চলে সবচেয়ে নিকটবর্তী আত্মীয় যশোর, সাতক্ষীরা প্রভৃতি অঞ্চলের ভাষা; খানিকটা আঞ্চলিক টান থাকলেও দেশে অন্যান্য অঞ্চলে সচরাচর যে ভাষা চলে, তার সাথে অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ এই ভাষা। কিন্তু বৃহত্তর খুলনার উত্তর পশ্চিম এলাকা জুড়ে বিশেষ করে ভৈরব নদীর পশ্চিম তীর থেকে দৌলতপুর মহেশ্বরপাশা, আড়ংঘাটা, তেলিগাতী, ডাকাতিয়া, ডুমুরিয়া উপজেলার সমগ্র উত্তরাংশ, বৃহত্তর গ্রাম রংপুর, শাহপুর, যশোর জেলার দক্ষিণ পূর্বাংশের দিকে তাকালেই দেখা যাবে আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। এসব এলাকার অধিবাসীদের মুখের ভাষা দৌলতপুরের আঞ্চলিক ভাষা, এমনকি এই ভাষায় স্মরণাতীতকাল থেকে লেখা হয়েছে বিভিন্ন গীত।

যেই খুলনাতে আঞ্চলিক ভাষার এত বাড়বাড়ন্ত , সেখানেই আবার টুক করে ঢুকে পড়েছে পরিশীলিত ও শ্রুতিমধুর নদীয়া-শান্তিনিকেতনি বাংলা। এ বিভাগের অন্তর্গত বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা পূর্বে ভারতের নদীয়া জেলার অন্তর্গত থাকায় কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা এলাকার অধিবাসীদের উচ্চারণে সেখানকার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় জোরেসোরে। ভাষাকে কি কাঁটাতারে বাঁধা যায়! এতরকমের ভাষার মাঝখানে আরো কিছুটা বৈচিত্র্য মিশিয়ে দিতে হাজির জঙ্গলা ভাষা। খুলনা বিভাগের পার্শ্ববর্তী সুন্দরবনের যে অঞ্চল আছে, সেখানকার ভাষাই সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষা নামে পরিচিত। সে ভাষায় লবণের কারখানা হয়ে যায় ‘খাদাড়ী/খালাড়ি’। আবার গাছে বসে শিকার করাকে সুন্দরবনের জঙ্গলা ভাষায় বলা হয় ‘গাছাল’।

এই তো গেলো ভাষার কীর্তন, কিন্তু ভাষার সাথেই তো মিশে থাকে সংস্কৃতি। এবার একটু তার কথা বলি! খুলনার সংস্কৃ্তি যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ, তেমনি এখানে দেখা মিলবে সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িক ঐক্যেরও। ঐতিহ্যবাহী গাজীর গানের জন্ম এই খুলনাতেই, পাশাপাশি চল আছে পালাগান, পদাবলী কীর্তন, অষ্টকগান, কবিগানেরও। যেই প্রবাদ ভাষাকে অলংকৃত করে, তেমন অনেক আঞ্চলিক প্রবাদও আছে খুলনার। যেমন ধরুন “ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো” প্রবাদটি খুলনার ভাষায় দাঁড়ায় “আড়ের রাগ বাড়ের সাথে, বৌয়ের রাগ ঝিয়ের সাথে”।

শেষতক যার কথা না বললেই নয়, তিনি বাউলসম্রাট লালন ফকির। এমন মরমীসাধকের চারণভূমি যেই অঞ্চল সেখানকার ভাষা-সংস্কৃতির এমন সমৃদ্ধি তো থাকবেই, কী বলেন!

তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: খুলনা (বাংলা একাডেমি, ২০১৪)
http://www.khulnadiv.gov.bd/

কন্টেন্ট: সুবাহ বিনতে আহসান
ক্রিয়েটিভ : ওয়াহিব অমিও

Leave a Comment

Scroll to Top