আরও বাক, আরও ভাষাঃ রাজশাহীর ভাষা এবং তার পরিচয়

প্রাচীন বরেন্দ্রভূমির অন্যতম প্রধান অঞ্চল রাজশাহী, যা পূর্বে রামপুর বোয়ালিয়া নামে পরিচিত ছিল। বলা হয়ে থাকে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর বিশ্বস্ত রাজা রামজীবনের জমিদারী রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল, যেখান থেকে পরবর্তীতে এ অঞ্চলের নামকরণ হয়। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও, ‘রাজশাহী’ শব্দটির ওপর যে বাঙ্গালী স্থানীয় শাসকের ন্যায় মুঘল শাসকের একটি প্রভাব ও প্রতিফলন আছে, তা মোটামুটি সব বিশেষজ্ঞরাই স্বীকার করেন।
বাংলা শব্দ ‘রাজ’ ও ফারসী শব্দ ‘শাহী’ যোগে এই নাম। এ থেকে বোঝা যায় অধুনা রাজশাহীতে বাংলাদেশের বাকি অঞ্চলগুলোর ন্যায় বাংলা ভাষার সাথে অন্যান্য বিদেশি ভাষাও সহাবস্থানে রয়েছে।

ইদানীংকালে শুদ্ধ ভাষা চর্চা, আঞ্চলিক ভাষার প্রতি তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিভঙ্গি সব মিলিয়েই আঞ্চলিক ভাষার স্বকীয়তা আড়ালে চলে গেছে। তবে রাজশাহীরও একটি ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। ভাষাবিদদের নিকট রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষা মূলত পরিচিত ‘বরেন্দ্রী’ উপভাষা হিসেবে। পদ্মা ও মহানন্দার তীর জুড়ে বসবাসকারী মানুষদের মুখের ভাষাই পরিচিত বরেন্দ্রী উপভাষা। রাজশাহী ছাড়াও মালদহ, নওগাঁ, দিনাজপুর অঞ্চলে এই উপভাষার প্রচলন রয়েছে।

রাঢ়ী উপভাষার সাথে বরেন্দ্রী উপভাষার বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। উল্লেখ্য রাঢ়ী উপভাষার পরিমার্জিত বাংলা রূপই বাংলা ভাষার শুদ্ধ লিখন রূপ । তাই বরেন্দ্রী উপভাষার সাথে কথিত শুদ্ধ বাংলার সাদৃশ্য লক্ষণীয়, এবং সহজ বোধগম্য।

ব্যকরণবিদ বা ভাষাবিদরা রাজশাহী অঞ্চলের এ ভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য – ধ্বনি তাত্ত্বিক, রূপ তাত্ত্বিক বিভিন্ন শ্রেনীতে বর্ণনা করেন। তবে সহজভাবে কিছু বৈশিষ্ট্য উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায়, যেমন এ অঞ্চলে ‘র’ এর উচ্চারণ লোপ পায় এবং ‘অ’ এর আগমন ঘটে, রাজশাহী কে আশশায়ী, রামপুরাকে আমপুরা, রাস্তা কে আস্তা বলতে শোনা যায়। আবার কিছু জায়গায় ‘র’ ধ্বনির আগমন ঘটে, যেমন ইন্দুর কে বলে রান্দুর । ‘আমাকে’, ‘তোমাকে’ ইত্যাদি বলার সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘এ কার’ উচ্চারন উহ্য থাকে। অবস্থান বুঝাতে ‘ঘরত’, ‘বাড়িত’, ‘ইশকুলত’ এ ধরনের ‘ৎ’ বিভক্তি যুক্ত হয়। ‘এ’ এর উচ্চারণ হয়ে থাকে ‘অ্যা’ এর মত যেমন, বেটাকে বলা হয় ব্যাটা।

রাজশাহী অঞ্চলের ভাষা মোটামুটি সমগ্র বঙ্গেই বেশ জনপ্রিয়। এ অঞ্চলের মানুষ কথা বলার সময় এক ধরনের সুর দিয়ে কথা বলে। খুব জনপ্রিয় একটি বাক্য, হাস্যরসের সাথেই শোনা যায়, “বুললে তো বুলবে বুলছে !”। এই সুর দিয়ে কথা বলাও ভাষার অংশই বলা চলে। ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গানে এই উপভাষা ব্যবহৃত হয়।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও রাজশাহীর জনগণের সাহসী ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। রাজশাহীতে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে শহরের ভুবন মোহন পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ দেশব্যাপী ‘ভাষা দিবস’ উদযাপন উপলক্ষে রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের একটি শহর কাঁপানো মিছিল ফায়ার বিগ্রেড এলাকায় পৌঁছাতেই তৎকালীন সরকারের মদদপুষ্ট পুলিশ বাহিনী মিছিলে অতর্কিত হামলা করে। এতে অনেকেই আহত ও রক্তাক্ত হন। সেই দিনগুলোতে সাদা কাগজে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লিখে ছোট ছোট টিনের কৌটায় মিছিলের মধ্যেই অর্থ সংগ্রহ করত ছাত্ররা। ভাষা আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিল, তাই সাধারণ মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে কৌটায় টাকা পয়সা দিত। স্কুলে স্কুলে গোপনে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো কাপড় বা কাগজ কেটে ব্যাচ বানিয়ে জনগণের জামায় লাগানো হতো। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনরত বন্দি ছাত্রনেতাদের উপর ১৯৫০ সালের ২ এপ্রিল পুলিশের অকস্মাৎ গুলিবর্ষণে ৭ জন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কারণে রফিক, শফিউর, জব্বার, বরকতসহ অনেক ছাত্র-জনতার মৃত্যু সংবাদ রাজশাহীর ছাত্রসমাজ ও জনতার রক্ত গরম করে তোলে। তাৎক্ষণিকভাবে রাজশাহী কলেজের ‘এ’ ব্লকের সামনে একসভায় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় যাদের উদ্যোগে ঢাকায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান জানিয়ে পুরনো ইট ও কাদামাটি দিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা মিনার নির্মাণ করা হয় রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের গেটের সামনে। কিন্তু ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ বাহিনী ওই স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলে। এটাকেই দেশের প্রথম শহীদ মিনার বলে দাবি করা হয়, যা পুননিরমাণের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান স্থানীয় সরকার। শহীদদের আত্মার মাগফিরাত এবং জনগণকে আরও সংগঠিত করার জন্য ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ভুবন মোহন পার্কে প্রতিবাদ সভা আয়োজন, সর্বাত্মক হরতাল পালন, কালো ব্যাজ ধারণ, বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা প্রদর্শন ইত্যাদি উদ্যোগ গৃহীত হয়। এ সময় এমএলএ মাদার বকশ্ এর ভাষা আন্দোলনে সমর্থন ও প্রতিবাদী বক্তব্য প্রদানের প্রেক্ষিতে তিনি রাজশাহীর জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনা লালনের উদ্যেশে গড়ে ওঠা দিশারী সাহিত্য মজলিস পত্রিকারও বিশেষ ভূমিকা ছিল ভাষা আন্দোলনে। ঘোড়ামারা ড্রামাটিক ক্লাব, সাংস্কৃতিক শিল্পী-পরিষদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক প্রচেষ্টাও পরবর্তীকালে রাজশাহীতে গণজাগরণ, সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

তাই, হোক আঞ্চলিক ভাষা কিংবা প্রমিত বাংলা ভাষা , মাতৃভাষার আলোচনায় রাজশাহীর অবস্থান অবিচ্ছেদ্য ও অনন্য।

তথ্যসূত্রঃ
১। বাংলাপিডিয়া
২। রহমান সুলতান, আমিনুর. (2013). বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা : রাজশাহী (ed.). বাংলা একাডেমি.
৩। ভট্টাচার্য, শ্রী পরেশচন্দ্র. ভাষাবিদ্যা পরিচয়
৪।খানম প্রধান, দ. (২০১৮, ফেব্রুয়ারী ১৬). রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন. দৈনিক জনকণ্ঠ.

কন্টেন্ট : পূর্বাশা পৃথ্বী।
ক্রিয়েটিভ : ওয়াহিব অমিও

Leave a Comment

Scroll to Top