লিখেছেনঃ মাসাফি মুস্তাফা হায়দার
গত শতাব্দী হতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে পৃথিবীর জীবাশ্ম জ্বালানি বা অনবায়নযোগ্য সম্পদ। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে বর্তমান উন্নত রাষ্ট্রসমূহে শিল্প উন্নয়নের মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে তেল, গ্যাস ও কয়লা। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক উন্নয়নের প্রায় দুইশত বছরের এই ধারা বিশ্বের শিল্পন্নোত দেশগুলোকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিলেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সারা পৃথিবীর জলবায়ুতে, যা বর্তমানে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ফেলেছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ও ক্ষতির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্বক প্রভাব বিবেচনায় রাষ্ট্রসমূহ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উন্নয়নসহ দূষণ রোধে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে প্রবেশ করেছে। তবে সমস্যা হলো অধিকাংশ চুক্তিতেই সকল রাষ্ট্র একমত হতে পারেনি। চুক্তিবদ্ধ হলেও চুক্তির অঙ্গীকারসমূহ পূরণে অনেক রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রগুলোর মাঝে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মনোমালিন্য।
বিশ্ব ২০১৫ সালে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্যারিস চুক্তিতে সই করে। এই চুক্তি অনুসারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য স্থির করার পরও বিশ্বব্যাপী যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। হিমবাহ গলে যাচ্ছে, ফসল বিনষ্ট হচ্ছে, গ্রামবাসীরা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণারত বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছিলেন যে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দফায় দফায় বন্যা- ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত, অতিবৃষ্টি, নজিরবিহীন জোয়ারে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনা ও অন্যান্য দুর্যোগ পরিস্থিতি তাদের কথার সত্যতাই প্রমাণ করে। জলবায়ু ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কোটি কোটি মানুষ ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পোকা-মাকড়ের অনেক প্রজাতি তাদের আবাসস্থলের বিশাল অংশ হারাবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা সংকট মোকাবিলা যতই জরুরি হোক না কেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব রুখতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা ব্যর্থ হলে আগামীতে এ সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে সারাবিশ্বের জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রাথমিক ধারণা
বর্তমানে পৃথিবীর আলোচিত এবং সংকটময় বিষয়গুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম প্রধান। গত শতাব্দীর শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বিভিন্নভাবে পৃথিবীর জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণকারী সংস্থা ইন্টার গভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি মানবসৃষ্ট বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন-মনো-অক্সাইড, মিথেন, সালফার ডাই অক্সাইডসহ আরও কিছু গ্যাস যারা গ্রীন হাউস গ্যাস হিসেবে পরিচিত, এই গ্যাসের পরিমাণ গত ১০০ বছরের মধ্যে অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত বিশ্বের শিল্পায়নের ফলেই মূলত গ্রীন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ বেড়ে চলেছে। এ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করে পৃথিবী সুরক্ষাকারী ওজনস্তরে ফাঁটল ধরাচ্ছে। ফলে সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে নানা ধরণের রোগ সৃষ্টির পাশাপাশি উষ্ণতাও বৃদ্ধি করছে। শিল্প কারখানা ও যানবাহন হতে প্রতিনিয়ত নির্গত গ্রীন হাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রাও ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্প বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময় হতে বর্তমান সময়ের মাঝে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ৩১ শতাংশ। একই সময় ব্যবধানে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে ১৫১ শতাংশ। বাতাসে এ ধরনের গ্যাসের পরিমাণ যত বেশি হবে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাও তত বেড়ে যাবে। ফলে জলবায়ুতে পরিবর্তন আসবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণায় দেখা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করবে (যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে)। বরফ গলে ও পানির সম্প্রসারণশীল ধর্মের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এর ফলে পৃথিবীর দ্বীপসমূহ ও উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। এছাড়া সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির সংখ্যা ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ত পানি উপকূলের অনেক গভীরে প্রবেশ করে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য, বনাঞ্চল, সুপেয় পানি, মৎস সম্পদ ও কৃষি ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
যারা আবাস্থল ছেড়ে অন্যস্থানে চলে যেতে বাধ্য হন, তারাই উদ্বাস্তু৷ মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু হচ্ছেন জাতিগত নিপীড়ণের কারনে৷ কিন্তু প্রকৃতিও মানুষকে উদ্বাস্ত করে, করছেও৷ পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এ ধরণের ঘরছাড়া মানুষগুলোকে বলছেন, ক্লাইমেট রিফিউজি বা জলবায়ু উদ্বাস্তু। জাতিসংঘের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১৭ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নিজের দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৮ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে এমন মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে কমপক্ষে ১৪৩ মিলিয়নে। অধিকাংশ জলবায়ু অভিবাসীদের আশ্রয় মিলছে উন্নত দেশে নয়, বরং উন্নয়নশীল দেশে (৮৫ শতাংশের অধিক)।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বাংলাদেশ পরিবেশগত দিক থেকে বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের অন্যতম দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এখানে বসবাসরত ১৬৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই ঝুঁকি সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত। ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০১৯’ অনুযায়ী চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সবচেয়ে বিপন্ন বা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বার্লিনভিত্তিক পরিবেশবিষয়ক সংগঠন জার্মানওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু ২০১৮ সালে জলবায়ুর বৈরী প্রভাবে সংঘটিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২.৮৩ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ বা ১৩ কোটির বেশি মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে নেমে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি গ্রাউন্ড-জিরো দেশ হিসেবে নিজের কোনো দোষ ছাড়াই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। দেশটি প্রায়ই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, তাপদাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে উত্তরাঞ্চলে খরা প্রবণতাও ক্রমেই বাড়ছে। বদলে যাচ্ছে বৃষ্টিপাতের ধরন। বাড়ছে বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ ও তীব্রতা। ২০১৯ সালে এক বছরেই বুলবুল এবং ফণী নামে দুটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ছিল তীব্র দাবদাহ। রেকর্ড শৈত্যপ্রবাহের ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৮ সালে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় তিতলি। ওই বছর আকস্মিক বন্যায় ভেসে যায় পূর্বাঞ্চল। ছিল বজ্রপাতের প্রকোপ এবং কালবৈশাখীর ছোবল। এছাড়া অস্বাভাবিক তাপ ও শৈত্যপ্রবাহ তো ছিলই। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগরে। সিলেট অঞ্চলে দুটি বন্যা হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার কারণে উত্তরাঞ্চলে একই বছর বন্যা হয়। ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আঘাত হানে। এর আগে ‘মহাসেন’, ‘আইলা’, ‘সিডর’ হয়ে গেল। ২০০৭ সালের পর মাত্র ১০ বছরে ৫-৭টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল। অথচ এর আগের ঘূর্ণিঝড়গুলোর সময় ব্যবধান আরও বেশি ছিল। পাহাড় ধস ঘটানোর মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে। টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে বড়টি বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গতবছর মে মাসের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সুপার সাইক্লোনে পরিণত হওয়ার কারণ ছিল সেই সময়ের বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠে অন্যান্য বছরের তুলনায় স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি বেড়ে যাওয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত বিশ্লেষণ বলছে- বাংলাদেশে ভবিষ্যতে চার ও পাঁচ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার ঝুঁকি ১৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এবং বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দারিদ্র্য হার সবচেয়ে বেশি৷ ১৯টি উপকূলীয় জেলায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে এক কোটি ১৮ লাখ ৷ বলা বাহুল্য, জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় এলাকার গরিব মানুষের জীবনধারণের জন্য চরম হুমকি৷ বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বায়ুর গতি প্রশমন করে ঝড়ের তীব্রতা থেকে আশেপাশের লোকালয়কে প্রাকৃতিক উপায়ে সুরক্ষা দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, সুন্দরবনের এই প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাও শিল্পায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
আইপিসিসি’র গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমান সময়ের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়বে যথাক্রমে ১.০ ও ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর গড় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আগামী শতকের শেষে ০.৬৯ মিটার বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক দেশেরই উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে গেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলেও তার প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশে সমুদ্রের পানির উচ্চতা আট মিলিমিটার করে বাড়ছে, যা বিশ্বের গড় বৃদ্ধির দ্বিগুণ৷ সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে এখন লবণ পানি উপকূলীয় এলাকা ছপিয়ে গোপলাগঞ্জ পর্যন্ত এসে পড়েছে৷ এর আগেই খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরসহ দক্ষিণের অনেক জেলা লবণ পানির গ্রাসে পড়েছে৷ লবণাক্ততার কারণে ফসল ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ২০৮০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে পানির উচ্চতা ২ ফুট বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশের ৪০ ভাগ এলাকা লবণ পানিতে তলিয়ে যাবে৷ এই ৪০ ভাগ এলাকায় প্রায় ৫ কোটি মানুষের বসবাস৷ লবণাক্ততার প্রভাবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, যেমন-উদ্ভিদ প্রজাতি ও স্বাদু পানির মাছ হ্রাস পাবে। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে, নিরাপদ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেবে, ফসলি জমি নষ্ট হবে, কৃষক-জেলে তাদের পেশা হারাবেন৷ তারা হারাবেন তাঁদের আশ্রয় বা আবাস৷
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়ছে৷ এরই মধ্যে ৬০ লাখ বাংলাদেশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুহারা হয়েছে। তার পরও আমরা ১১ লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে চলেছি, আর সে জন্য আমাদের পরিবেশগত মূল্যও দিতে হচ্ছে। ঢাকার বস্তি এলাকায় বসবাসকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে স্থানান্তরিত বলে জানিয়েছে অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমও৷ জলবায়ু পবির্তনের শিকার হয়ে যারা ঢাকায় এসেছেন তারা নিয়মিত কাজ পাচ্ছেন না৷ তারা আগে প্রধানত কৃষক ছিলেন৷ কিন্তু এখন তারা বলতে গেলে পেশা উদ্বাস্তু৷ নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই৷ এ ধরণের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে পরবর্তীতে এদের পুনর্বাসনের জন্য যে কোন সরকারকে পড়তে হবে অর্থনৈতিক সমস্যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ প্রকল্পে দাতাদের ভূমিকা এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ
বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী না হলেও এর কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ৷ প্রায়ই অতিবৃষ্টি, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরাসহ নানান দুর্যোগের মুখে পড়ছে দেশগুলো ৷ কিন্তু এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো তথ্য-প্রযুক্তি বা রসদ তাদের কাছে নেই। ফলে প্রতিটি দুর্যোগের পর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দেশগুলোকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে ৷ শিল্পোন্নয়ন তথা কার্বন নিঃসরণের জন্যই আজকের এ বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তন। আর তাই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দেশগুলোর দাবি হচ্ছে, শিল্পোন্নত দেশগুলো যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত দায়ী, সেহেতু তাদেরই ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করায় অগ্রগতি সামান্য৷ মূলত বিশ্ব নেতাদের ঐক্যমতের অভাবেই জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে শক্ত নিয়ম নীতি নির্দিষ্টকরণের পরও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠছে না।
বিশ্বে ৮০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী জি-২০ভুক্ত শিল্পোন্নত দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব দূর করতে তাই দ্রুত কার্বন নির্গমন কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ যেমন ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ১৯৯৯ সালের তুলনায় কমপক্ষে ৫৫ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করার চেষ্টা চলছে৷ পাশাপাশি ২০৫০ সালের মধ্যেই জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে তারা ৷ এক ঢিলে দুই পাখি মারতে করোনা সংকট মোকাবিলার জন্য গঠিত ৭৫ হাজার কোটি ইউরো মূল্যের তহবিলও কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে৷ বিভিন্ন দেশে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির ব্যবহার কমাতে সহায়তা হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে৷ ১,৭৫০ কোটি ইউরো অংকের সেই ‘জাস্ট ট্রানজিশন ফান্ড’ কয়লাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জ্বালানির ব্যবহার কমাতে সাহায্য করবে৷ তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ বিশেষ করে ‘কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকলানিজম’ নামের উদ্যোগের আওতায় ইইউ নিজস্ব প্রভাব কাজে লাগিয়ে বাকি বিশ্বের উপর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি কাজে লাগানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করতে চায়৷ অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক বাজারে নিজস্ব পণ্য বিক্রি করতে হলে অন্যান্য দেশকে কার্বন নির্গমন কমাতে হবে৷ চীন, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ এমন চাপের আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷
বড় অর্থনীতির দেশগুলো ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে অর্থায়ন করার কথা থাকলেও বাস্তবে তহবিল পাওয়া গেছে এর চেয়ে অনেক কম। প্রায় সকল রাষ্ট্র এই চুক্তিতে সম্মতি দিলেও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলো। ডোনাল্ড ট্রাম্প অ্যামেরিকার চাঁদা আটকে রাখায় ২০২০ সালে সেই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হয় নি৷ সম্প্রতি ওয়াশিংটনে ক্ষমতার পালাবদলের পর অ্যামেরিকা আবার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে৷ অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলিকে এই উদ্যোগে সামিল করতে ১০ হাজার কোটি ডলার অংকের বাৎসরিক তহবিলের পক্ষেও সমর্থন প্রকাশ করেছে বাইডেন প্রশাসন৷
বর্তমানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা যে অবস্থানে রয়েছে সেটা বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের শিল্পায়নের ফলাফল হওয়ায় চীন, ভারত ও আরো কিছু উন্নয়নশীল দেশ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সব ধরণের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে পশ্চিমা বিশ্বকে এবং তাদেরকে কার্বন নিঃসরণও কমাতে হবে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর এই রেষারেষির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সূচক অনুসারে প্রথম দশটি ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রের ৮টিই স্বল্পোন্নত এবং ১টি মধ্যম আয়ের দেশ। রাষ্ট্রের মত বায়ুমন্ডল দূষণের কোনো নির্দিষ্ট সীমানা নেই। এক দেশের উৎপন্ন কার্বন পুরো বায়ুমন্ডলকেই উত্তপ্ত করতে পারে, যার প্রভাব পুরো বিশ্বেই পড়বে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর সেই প্রভাব মোকাবেলার সক্ষমতা থাকলেও দরিদ্র দেশগুলোর তা নেই। ফলে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা।
কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানো কিংবা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তার ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি যেমন কম, তার চেয়েও কম হচ্ছে প্রতিশ্রুতি রক্ষার তাগিদ। সবুজ জলবায়ু তহবিলের (জিসিএফ) অধীনে ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের কথা থাকলেও গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে। এমনকি অনুদান দেয়ার পরিবর্তে ‘ছদ্মবেশী ঋণ’ দেয়ার কৌশল নিয়েছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। এতে জলবায়ু-ঋণের ফাঁদে পড়ছে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। ‘জুবলি ডেট ক্যাম্পেইন’- এর তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার ৬৩টি দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশের সরকারকে ২০১১ সালে ১৩৩% বৈদেশিক ঋণ প্রদানের প্রয়োজন পড়ে যার পরিমাণ ২০২২ সালে ২১৬% এ দাঁড়াবে। আইএমএফ তথ্য অনুযায়ী, ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশ গ্রানাডা, ডমিনিকা, হাইতি, কিরিবাতি, মালদ্বীপ, সামোয়া, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, টঙ্গা, টুভালু, ভানুয়াতুসহ বিভিন্ন দ্বীপদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইতিমধ্যে ঋণে জর্জরিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সাধারণত, যে কোন দুর্যোগে পড়লে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় এসব স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করতে হয়। এমনকি সাম্প্রতিককালে সাইক্লোন ইদাই এ দুর্যোগের শিকার মোজাম্বিক, মালি এবং জিম্বাবুয়ে হতে এক মিলিয়ন জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হলেও তাদের প্রয়োজনীয় অনুদানভিত্তিক অর্থ সহায়তা প্রদান করেনি জলবায়ু ক্ষতিপূরণ সনদে সাক্ষরকারী শিল্পোন্নত দেশগুলো। ফলে, ইদাই এ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বিশ্বব্যাংক থেকে ৭০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য প্রদত্ত অঙ্গীকারের বিপরীতে দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থপ্রাপ্তির জন্য নতুন ধরনের বিমা ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্রতিশ্রুত অর্থ প্রাপ্তিকে অনিশ্চিত করছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনা সংকটে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ নতুন করে চরম দারিদ্র্যের শিকার হবে, যাদের বেশিরভাগেরই বসবাস দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে। ফলে জলবায়ু সংকটের পাশাপাশি করোনা সংকটেও এই দেশগুলোর ঋণগ্রস্ততা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে।
‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম’-এর একটি প্র্রতিবেদনে জানানো হয়- ২০৩০ সাল নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো প্রতি বছর কমপক্ষে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আরেক হিসাবে বলা হয়- উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কমপক্ষে বছরে ৪০০-৪৩০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মোকাবেলা করতে হবে। এমনকি এর পরিমাণ বেড়ে সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতি ৬০০-৭০০ বিলিয়ন ডলারেও দাঁড়াতে পারে। মনুষ্য বাসের এই পৃথিবীতে যাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে না আসে সেজন্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মধ্যে থাকা সব স্বল্পোন্নত দেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের আন্দোলন জরুরী। শিল্পোন্নত দেশগুলোকে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে এ সমস্যা মোকাবেলার জন্য। যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যেই প্রতিশ্রুতি রাখার মাধ্যমে নজির সৃষ্টি করছে। ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্য ১১ দশমিক ছয় বিলিয়ন পাউন্ড প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। পাশাপাশি এ বছরই নভেম্বর মাসে যুক্তরাজ্য গ্লাসগো শহরে ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক সম্মেলন কপ-২৬ আয়োজন করবে এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশকে স্বাগত জানাবে। এই সম্মেলন আমাদের জন্য বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় সাহায্য করার ও আমাদের সকলের জন্য একটি পরিবেশ বান্ধব, পরিচ্ছন্ন, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার বিশাল সুযোগ।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাংগঠনিক ও সরকারি কাঠামো
শিল্পোন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও ক্ষতিপূরণ আদায়ে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। যেসব দেশের কারণে বাংলাদেশকে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে সেই দেশগুলো ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুত অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে না। প্রতিবছর ক্ষতির এ পরিমাণ বাড়লেও বাংলাদেশ এখনও সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে উল্লেখযোগ্য কোনও প্রকল্প বা অর্থ আদায় করতে পারেনি। সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশসহ ১০টি দেশকে সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ) মাত্র ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আবহাওয়ার আকস্মিক দুর্যোগে ২০১৮ সালে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যতম দেশ বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমন প্রকল্পের মাধ্যমে এই ক্ষতি পূরণ বা পরিহার করা যেত। কিন্তু ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ৩টি প্রকল্পের জন্য পেয়েছে অনুমোদিত সর্বমোট তহবিলের মাত্র ০.০৭ শতাংশ (মাত্র ৮৫ মিলিয়ন ডলার)। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ততা অনুসারে, বাংলাদেশের শুধু জলবায়ু অভিযোজন বাবদ বছরে দরকার ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু নীতিমালা, প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও অদক্ষতার ফলে এ খাতে বরাদ্দ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ব্যাপারটা নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে না। গরিব ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা কম বলে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূলত এই কারণেই জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০০৯ সালে আলাদা দু’টি তহবিল গঠন করে৷ একটি হলো বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি) এবং অন্যটি বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়ান্স ফান্ড (বিসিসিআরএফ)৷ পাশাপাশি ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) কাজ শুরু করে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টিবোর্ড কর্তৃক ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত ২ হাজার ৮ শত ৮৯ কোটি ২০ লাখ ২৯ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৫৬২টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫৯টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। বেসরকারি প্রকল্পগুলো মনিটিরিং-এর দায়িত্বে আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান পল্লি কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ক প্রকল্পের আওতায় নদীভাঙন রোধে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেয়া হচ্ছে৷ এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে ৷ এই অবস্থার সমাধান হিসেবে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা লবণ সহিষ্ণু কয়েকটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন৷ একই বৈশিষ্ট্যের একটি পাটের জাতও উদ্ভাবিত হয়েছে৷ এছাড়া খরা ও বন্যা সহিষ্ণু ধানের জাতও উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের গবেষকরা৷ জিসিএফ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় না পেলেও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজস্ব অর্থায়নে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল গঠন করে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশ এখন বছরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ঝুঁকি মোকাবিলায়, যা জিডিপির শতকরা ২ ভাগ৷ ২০৩০ সাল পর্যন্ত সরকার এই খাতে ব্যয় করবে আরও চার হাজার কোটি ডলার। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করেছে।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে এতসব পদক্ষেপ নেয়া হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনোটির। জলবায়ু তহবিল বরাদ্দে গুণগত মানের বদলে রাজনৈতিক প্রভাব বেশি কাজ করছে৷ স্থানীয় জলবায়ু বিপন্নতা ও বরাদ্দের মধ্যে অসামঞ্জস্যতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফান্ড নিয়ে নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে বারংবার৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি-র অভিযোগ, জলবায়ু তহবিলের টাকা সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছে৷ পারমাণবিক শক্তি, নবায়নযোগ্য এনার্জি ও সবুজ এনার্জি এক কাতারে ফেলে কার্বন গ্যাসমুক্ত জ্বালানি হিসেবে দেখানো হয়েছে৷ তাদের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, ঋণ নেয়া ৫৫টি এনজিও-র কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এছাড়া ১০টি নামসর্বস্ব, ১৩টি রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং মাত্র ১৭টি এনজিও ঠিকমতো কাজ করছে৷ এখানেই শেষ নয়৷ জলবায়ু তহবিলের অর্থায়ন নিয়ে রাজনীতিকরণ ও দুর্নীতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছে টিআইবি৷ টাকা পাওয়া ১৩টি এনজিও-র নির্বাহী অথবা পরিচালনা পর্ষদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত৷ তাই রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে প্রকল্প পেয়েছে ৯টি এনজিও৷ প্রকল্পের আওতায় এমন সব স্কুল তৈরি করা হয়েছে, যেখানে দুর্যোগের সময় মানুষ আশ্রয়ও নিতে পারবে৷ কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, যেখানে বেশি দরকার, সেখানে এমন ভবন নেই৷ জলবায়ু বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে যে তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে তা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে বণ্টন করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক এ টাকা অনুদান হিসেবে না দিয়ে ঋণ হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনুদানের পরিবর্তে ঋণ দেওয়া বাংলাদেশের অনুদান চাওয়ার নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে ফেলছে। ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে ঋণ দেওয়াকে অনৈতিক উল্লেখ করে পরিবেশবাদী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এ ঋণ না নেওয়ার জন্য আহ্বান জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে তা মানা হয়নি। এদিকে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সহায়তার পরিমাণ কমিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে বিদেশি দাতারা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায়, বিশেষত ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলীয় জনবসতি ও সম্পদ রক্ষায় সুদৃঢ় বর্ম হিসেবে সুন্দরবনের অবদান অনস্বীকার্য। ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন নির্ভরযোগ্য সুরক্ষা বেষ্টনী হয়ে বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশের মানুষের প্রাণ ও সম্পদ রক্ষা করে আসছে। বাংলাদেশে আঘাত হানার আগেই সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় সমূহের শক্তি হ্রাস করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন। আর এ সত্য আবহাওয়া অধিদফতরসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট মহল স্বীকার করেছে। এর আগেও প্রলয়ংকরী সিডর, আইলাসহ অন্যান্য দুর্যোগ ও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপকতর হতে দেয়নি সুন্দরবন। কিন্তু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও পরামর্শ উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কৌশলগত পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল, তালতলি ও কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বহুমুখী ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পায়ন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বাংলাদেশে ২০৩০ সাল নাগাদ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৩৩ হাজার ২৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে বার্ষিক ১১ কোটি ৫০ লাখ টন অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসৃত হবে। এই কার্বন নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বাংলাদেশের জলবায়ু দুর্যোগে দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব চরম হুমকির মুখে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তন, শরণার্থী সংকট ও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয়
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। আমরা ইতোমধ্যেই জলবায়ু সংকটের সম্মুখীন। অধিক জনসংখ্যা ও বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা জলবায়ু ও পরিবেশগত সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার চ্যালেঞ্জটাও এখানে বেশি। জলবায়ু উদ্বাস্তু সংকট ও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের নিজস্ব জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা থাকা একান্ত প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মূলত করণীয় বিষয়কে বিশেষজ্ঞরা দুই ভাবে দেখছেন। প্রথমত, বাংলাদেশ ক্ষতিকর গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ কমাতে পারে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ খুব সামান্যই অবদান রাখছে বায়ুমণ্ডলের মোট গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের অনেক ব্যবস্থা নিতে পারি। যেমন- শক্তি সাশ্রয়ী বাল্বের ব্যবহার, ইটের ভাটা ও অন্যান্য কল কারখানার ক্ষতিকর কার্বন নির্গমন কমানো, সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ু বিদ্যুৎ এর ব্যবহার বৃদ্ধি এবং জ্বালানীর সাশ্রয় ও অপব্যবহার কমানো ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, যে কাজটি এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে করা উচিত সেটা হচ্ছে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে আমাদের এডাপ্টটেশন বা অভিযোজন। এই অভিযোজন হবে কাঠামোগত ও কাঠামোবিহীন। কাঠামোগত অভিযোজন এর মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় বাঁধ ও নদীর বাঁধ এর উচ্চতা বৃদ্ধি, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে নতুন নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা, বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ভিত্তির উচ্চতা বৃদ্ধি করা। কাঠামোবিহীন অভিযোজন এর মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় বনায়ন যা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এর তীব্রতা কমাবে, লবণাক্ততা সহনশীল ধান উৎপাদন, মৎস্যজীবীদের জন্য বিকল্প জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এছাড়াও জলবায়ু শরণার্থীদের গৃহায়ন ও জীবনজীবিকার ব্যবস্থার কথাও আমাদেরকে ভাবতে হবে।
বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন কিছু কিছু অঞ্চলের আবহাওয়ার সংকটময় অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তুলবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মোটামুটি ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে আরও বেশি হুমকির মুখে ফেলবে। এ ছাড়া এটা স্পষ্ট যে ঝুঁকিপূর্ণ জলবায়ু সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য অন্যতম, তাই আমাদের উচিত দারিদ্র্য কমাতে সাধারণ নীতিমালা তৈরি করা। উপকূলীয় অঞ্চলগুলো বন্যা ও অন্যান্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, তাই এসব অঞ্চলের সমস্যার সমাধানের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।আমাদের বন্যা প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ও এর ঝুঁকি কমাতে আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে যাতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে মানুষ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। অনেকে বর্তমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ব্যবহার করে না, কারণ সেখানে তারা তাদের গবাদিপশু ও অন্যান্য মূল্যবান প্রাণিসম্পদ রাখার ব্যবস্থা করতে পারে না, তাই প্রস্তাবিত কাঠামো মানুষ এবং গবাদিপশু উভয়ের বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে। বাংলাদেশের এই ধরণের কাজে বিশেষ করে আশু পূর্বাভাস প্রদান ও দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের উদ্ধার ব্যবস্থার মাধ্যমে জীবন বাঁচানো, খাদ্যের উৎসকে সুরক্ষিত রাখার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ফসল ফলনে অগ্রগতি দেখিয়েছে।
শুধু দুর্যোগ থেকে রক্ষায় নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবেই নয়, সুন্দরবন এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম রক্ষাকবচ। কিন্তু উপকূলজুড়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণের ফলে জলবায়ু অভিযোজনজনিত ব্যয় বাড়বে যা শুধু জলবায়ু সহিষ্ণুতা অর্জনই নয়, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রারও পরিপন্থি। এ পরিপ্রেক্ষিতে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহারের পরিবর্তে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতিশ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি বিবেচনায় জেলা-উপজেলাভিত্তিক জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা চূড়ান্ত এবং ‘ক্ষয়-ক্ষতি’ মোকাবেলায় একটি জাতীয় কাঠামো প্রণয়নসহ বিপন্ন মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভের সংরক্ষণের পাশাপাশি পুনরায় বৃক্ষ রোপণ করতে পারে, যেটি পরিবেশকে কার্বনমুক্ত করার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করবে।
এই শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নেট-জিরো লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের অবশ্যই কার্বন নির্গমন হ্রাস করার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। নবায়নযোগ্য ও পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি শক্তির প্রতি আগ্রহ ও ব্যবহার বাড়াতে হবে। যে সব জিনিসের দাম কৃত্রিমভাবে কমিয়ে রাখতে কয়লা ও তেল ব্যবহার করা হয়, তাদের উপর হতে ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অধিক জ্বালানী দক্ষ আর কম দূষণ সৃষ্টিকারী গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। বিদ্যুতের অপচয় রোধ ও কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হবে।
পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থায়ন ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াবে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ৷ তাই আমাদের প্রস্তুতি হতে হবে জুতসই। জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা কেবল সরকার বা বেসরকারি সংস্থার পক্ষে সমাধান সম্ভব না। দেশের জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হয়ে সময়োচিত পদক্ষেপ ও সঠিক প্রকল্প নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে ৷ চলমান করোনা সংকটকে জলবায়ু সংকট অপেক্ষা আলাদা করে না দেখে যৌথভাবে উভয় সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
উপসংহার
আধুনিক বিশ্ব এখন অতি আধুনিক। অতি প্রযুক্তিনির্ভর। প্রযুক্তিনির্ভরতার অর্থ এই নয় যে, প্রকৃতিকে ধ্বংসের দিকে দিন দিন ঠেলে দেয়া। ভোগ ও বিলাসীতায় ডুবে থাকা আধুনিক বিশ্বের মানুষ আজ পৃথিবীকে বসবাস অনুপযোগী বানিয়ে ফেলছে দিন দিন। অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় মানবসভ্যতা আজ কঠিন পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমরা যদি এভাবে চলতে থাকি তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তীব্রতর হতে থাকবে এবং আগের চেয়ে এই প্রভাব আমাদের ওপর আরও দ্রুত পড়বে। ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার আমাদের ধারণা দেয়, বিশ্বের দেশগুলো যদি তাদের নিজ নিজ নির্গমন হ্রাস লক্ষ্যমাত্রায় অবিচল থাকে তবুও বিশ্বের গড় তাপমাত্রা দুই দশমিক চার ডিগ্রি বৃদ্ধি পাওয়ার পথে। এমন অবস্থায় আমাদের অবশ্যই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। আগামী বছর গুলোতে নির্গমন হ্রাস করতে আমাদের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া বাঞ্ছনীয়।অনিয়ন্ত্রিত জলবায়ু পরিবর্তন—সর্বনাশা খরা, দুর্ভিক্ষ, বন্যা ও গণবাস্তুচ্যুতিতে—নতুন অভিবাসনের ঢল উসকে দেবে এবং এর পুনরাবৃত্তি উল্লেখযোগ্যহারে বাড়াবে। পানি, আবাদিভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে সংঘাত আরও তীব্রতর হবে। তাই কোভিড-১৯ থেকে উদ্ধারের আদলে অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে পরিবেশ বান্ধব কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পরিচ্ছন্ন বায়ু নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন কোনো আঞ্চলিক বিষয় নয়। এর প্রভাব কোনো সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা মেনে চলে না। এটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের একটি সাধারণ বৈশ্বিক দায়। তাই পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার পদক্ষেপগুলোও হতে হবে বৈশ্বিক। সময় এসেছে আসন্ন কপ-২৬ সম্মেলনের মাধ্যমে উন্নত-উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রেখে পরিবেশ বান্ধব কর্মসংস্থান ও পরিচ্ছন্ন বাতাসসহ একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার শেষ সুযোগ এই কপ-২৬ সম্মেলন। অন্যথায় ক্রমবর্ধমান উষ্ণ ধরনী অচীরেই মানুষ এবং অন্যান্য জীব-বৈচিত্র্যের জন্য বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।