বিশ্ব শ্রমিক দিবস: করোনাকালীন শ্রমজীবন

লিখেছেনঃ মাসরেফা তারান্নুম
গত বছরের এ সময়টাতে ফিরে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই? সদ্য করোনা আক্রান্ত দেশে আমরা যখন লকডাউনের সাথে মানিয়ে নিচ্ছি, সাধ্যমতো নিজেদের বন্দী করেছি সুরক্ষার আবরণে, হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক হাটা ময়মনসিংহ থেকে পায়ে ফিরছিলেন ঢাকায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো- কাজে যোগ দেওয়া৷ কাজ না করলে বেতন আসবে কোথা থেকে- প্রাণঘাতী ভাইরাসের জন্য তাই কাজ থেমে থাকলে চলবে কেন?
জীবনের মায়া না করে জীবিকার তাগিদে ছোটা এই কর্মীদের পরিস্থিতি এক বছর পরেও খুব একটা ভিন্ন কিছু নয়। সম্প্রতি ইউএনডিপি ও ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষণায় উঠে এসেছে যে ২০২০ সালে দেশের ৩৫ ভাগ পোশাক কর্মীর বেতন কমেছে৷ সিপিডির গবেষণা বলছে একই সময়ে শুধুমাত্র এই খাতেই চাকরি হারিয়েছেন তিন লাখ ৫৭ হাজার শ্রমিক৷ এবং বরাবরের মতো কর্মী ছাটাইয়ের সময় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই নিয়ম মানেনি৷ মাত্র ৩.৬ শতাংশ কারখানা ক্ষতিপূরণের নীতি মেনেছে৷ বাকিদের পরিণতি কি হয়েছে?
স্বাভাবিকভাবেই পোশাক খাতকে রক্ষা করার জন্য নেওয়া হয় সরকারি উদ্যোগ। সরকার পোশাক খাতের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে কয়েক ধাপে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ প্রণোদনা ঋণ হিসেবে দেয়। পাশাপাশি এই খাতের চলতি মূলধনের জন্য প্রণোদনা দেওয়া হয় আরো ৫০ হাজার কোটি টাকা। এবারো ঈদের আগে বেতন ও বোনাস বাবদ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা চেয়েছেন পোশাক শিল্পের মালিক সংগঠনগুলো। তবে দুঃখের বিষয় হলো বিপুল প্রণোদনা সত্ত্বেও
গতবছর পোশাক খাতের ৬৪টি কারখানার প্রায় ২১ হাজার শ্রমিক মজুরি পাননি। কাজ নেই, আর স্বাস্থ্যবিধির অজুহাতে ওই শ্রমিকদের মজুরি না দিয়ে ছাঁটাই করা হয়। শ্রমিক স্বার্থ তদারকি করা সরকারি কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডাইফি) প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে। এ তো গেলো শুধু পোশাক শিল্পের কথা।
গত মার্চে সৈয়দপুরের পাঁচটি বেসরকারি পাটকল বন্ধ হয়ে পড়ায় বেকার হয়েছেন এর সাথে জড়িত প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক৷ করোনার প্রকোপে তাঁতশিল্প হুমকির মুখে। তাঁত ব্যবসায়ী সমিতির দেওয়া তথ্য মতে, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ৬ লক্ষাধিক তাঁতের মধ্যে ৪ লাখই বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ এবং এই শিল্পের সাথে জড়িত আড়াই লাখ শ্রমিক বর্তমানে বেকার জীবনযাপন করছেন। করোনার জন্য অন্যান্য অনেক শিল্পের মতো তাঁত শিল্পের জন্য কোনো প্রণোদনা ও ভর্তুকি দেওয়া হয়নি৷ এছাড়াও নতুন করে সংকট দেখা গিয়েছে আসবাব খাতে। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত চামড়াশিল্পের প্রতি অবহেলাও প্রতীয়মান। এই খাতকে আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত বলা হয়ে থাকলেও যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগের অভাবে পতনশীল। করোনার জন্য ইতালী ও ভারতের চামড়াশিল্প যখন সংকটে, সেই সুযোদের সদ্ব্যবহার করেছে চীন তাদের ট্যানারি শিল্প সচল রেখে। অথচ এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে চামড়াশিল্পকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে পারতাম আমরাও৷
পর্যটনখাতের শ্রমিকদের অবস্থা আলাদা কিছু নয়৷ সব ধরনের পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই অজুহাতে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে বিভিন্ন হোটেল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে এখাতের এক তৃতীয়াংশ শ্রমিক হাঁটছে কর্মহীন হওয়ার পথে। ছাটাইয়ের সময় পাওনা মজুরি বা বেতন- ঠিকমতো পরিশোধ করা হচ্ছেনা একটিও৷ উল্লেখ্য হোটেল- রেস্তোরাঁর প্রায় ২০ হাজার কর্মী সরকারি প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত।
মহামারীর মধ্যে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দিকে যদি আমরা তাকাই, নূন্যতম ব্যবস্থা নিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে৷ বিদায়ী বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু ঘটেছে ১০৪৫ জন শ্রমিকের, যাদের বেশিরভাগ পরিবহন শ্রমিক৷ লক ডাউনের কারণে গণ-পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হলে আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায় এ খাতে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের৷ শহরাঞ্চলের অসংখ্য রিকশাওয়ালার কান্না আমরা দেখেছি। কোনো ধরনের আয় রোজগার নেই, তার ওপর রয়েছে পুলিশি হয়রানি। পরিবার ও সন্তানের মুখে খাবার জোগাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও লকডাউনের উপেক্ষা করেই রাস্তায় আসছেন নিম্নআয়ের রিকশাচালকরা।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্কলন অনুযায়ী বিগত এক বছরে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারী হিসাবে তা আরো অনেক বেশি৷ বিআইজিডির জরিপে প্রকাশ করেছে যে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ৷ সানেমের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারীতে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিলো৷ বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নাগরিককে দারিদ্র্যসীমার উপরে টেনে তুলতে দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। এই যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছে, তারা কীভাবে দিনাতিপাত করছেন, তাদের কর্মসংস্থানে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আদোও কি কোনো পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত নেই৷ ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের প্রতি মানবিক হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে৷ বাস্তবিকপক্ষে করোনা পরিস্থিতিতে আমরা কতটুকু মানবিক হতে পেরেছে আমাদের শ্রমিকদের প্রতি?
প্রতিবারের মতো এই বছরের মে দিবসও বেশ ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করা হবে। জাতীয় কবি লিখেছিলেন- তোমারে সেবিতে হইলো যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি; তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগালো ধূলি/ তারাই মানুষ তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান; তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান! চির-বিদ্রোহীর এই দুটো লাইন সময়ের উর্ধ্বে, এখনো আমাদের শ্রমিকদের অবস্থান তুলে ধরে৷ হিসাবের খাতায়, অর্থনীতির সংখ্যায় বাংলাদেশের অর্জন অনেক, ব্যর্থতার পাশাপাশি আমাদের প্রাপ্তি অনেক। অদূর ভবিষ্যতে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাবো, বিশ্বদরবারে আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি ও সামর্থ্যের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল হবে। এই অর্জনের ভিত্তি যাদের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই শ্রমিকজনগোষ্ঠীর কাছে আমাদের অনেক ঋণ জমা হয়ে আছে। মহামারীর নিষ্ঠুরদিনগুলোতে তাদের যাতে আর অবিচারের সম্মুখীন হতে না হয়, নাগরিক হিসেবে দেশের প্রত্যেকটি শ্রমিকের সুবিধা যাতে আমরা সুনিশ্চিত করতে পারি, এই হোক এ বছরের মে দিবসের প্রত্যয়।
ছবিঃ দীপু মালাকার
তথ্যসূত্রঃ

Leave a Comment

Scroll to Top