বিশ্ব শ্রমিক দিবস: বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা

লেখক: আজিজুন নাহার লিমা
শ্রমিকরা দেশের মূল চালিকাশক্তি। তাদের কাঁধে ভর করে, তাদেরই অক্লান্ত পরিশ্রমেই এগিয়ে যায় একটি দেশ। আর এই শ্রমশক্তির একটি বিশাল অংশজুড়ে নারীরাও নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। “Labour Force Survey-2010” অনুযায়ী ২০১০ সালে দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১.৭২ কোটি । বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু নারীরা শ্রমিক হিসেবে ন্যায্য অধিকার পেয়েছেন কি? বর্তমানে বাংলাদেশে নারী শ্রমিকদের অবস্থান কোথায়? এসব প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
শ্রমিকদের কিছু নির্দিষ্ট অধিকার ও প্রয়োজন থাকে। নারীদের জন্য এই ব্যপারটি আরো বেশি জরুরি। বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থনকৃত আইএলও এর ৭ টি কনভেনশনে নারী শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এর ৯৩,৯৪,৯৫ ধারা অনুযায়ী মহিলা শ্রমিকদের জন্য বিশ্রাম কক্ষ, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রসহ মহিলাদের কল্যাণে বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেশের খুব কম জায়গাতেই নারী শ্রমিকদের জন্য বিশ্রাম কক্ষ বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে শ্রম আইনে গুরুত্ব দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যাতীত অন্যান্য জায়গায় নারীরা খুব কমই পূর্ণ ৬ মাসের ছুটি পান। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছুটির পরিমাণ এর অর্ধেক। পূর্ণ ছুটি দিলেও সেক্ষেত্রে তাদের ঐ মাসগুলোর বেতন দেওয়া হয়না। আর যেসব নারীরা শিল্পকারখানায় কায়িক শ্রম দেন, যেমন গার্মেন্টস শিল্পে; সেসব জায়গায় অনেক নারী গর্ভবতী হলে চাকরিচ্যুত হন৷
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ -বিআইডিএস এর গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, “আনুষ্ঠানিক খাতে যত উচ্চ পদে নারী কাজ করেন, সেখানে আয় বৈষম্য ততই কম।” অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য বেশি কারণ হলো কত বেতন হবে, কাকে কত টাকা মজুরি দেয়া হবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। যেমন, নারী শ্রমিক যারা রাস্তার কাজ করছেন, ইট ভাঙছেন কিংবা রাস্তা-ঘাট নির্মাণের সাথে আছেন, তারা ৩০-৪০% পর্যন্ত মজুরি কম পেয়ে থাকেন। যেসব কাজে পুরুষরা দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা পান, সেসব কাজে নারীরা পান ২০০-৩০০ টাকা। চাকরির পদন্নোতির ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অথচ আইএলও কনভেনশন ১০০ এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) এর ৩৪৫ ধারা অনুসারে একই প্রকৃতি, একই মান বা মূল্যের কাজের মজুরী নির্ধারণের সময় নারী ও পুরুষ সকলের জন্য সমান মজুরী নীতি অনুসরণ করতে হবে।
সমগ্র অর্থনীতিতে নারীরা অবদান রেখে চলেছে। অথচ, প্রায় অনেক কর্মক্ষেত্রে নারী এখনও অনিরাপদ। পুরুষ সহকর্মী ও কর্মক্ষেত্রের মালিকপক্ষ হতে প্রায় নারী শ্রমিকদের যে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, সে কথা আজ কে না জানে? এসব ক্ষেত্রে নারীরা অভিযোগও করতে পারেনা। কারণ তাতে তাদেরকে চাকরি হারাতে হয়। এ ধরনের প্রতিকূল কর্মপরিবেশ এর জন্য নারীদের উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হয়।
নারী শ্রমিকেরা পুরুষ শ্রমিকদের দ্বারাও যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। মৌখিক নোংরা কথাবার্তার অভিযোগ আসে হরহামেশাই। কিন্তু সেসব কেউ আমলে নেয়না। কয়েকটি এনজিও’র তৈরি একটি প্ল্যাটফর্ম ‘সজাগ কোয়ালিশন’ একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো। চারটি এলাকার আটটি কারখানার শ্রমিকের ওপর করা ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ২২ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন যে তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। যৌন হয়রানি হিসেবে কারখানায় প্রবেশের সময় নিরাপত্তা কর্মীদের অস্বস্তিকরভাবে দেহ তল্লাশি, পুরুষ সহকর্মীর অপ্রত্যাশিত স্পর্শ, মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্বারা যৌন সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা, সম্পর্ক তৈরি না করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন – এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এর ক্ষেত্রেও নারী শ্রমিকরা পিছিয়ে আছেন অনেকটাই। নারীদের মধ্যে বেশিরভাগই অদক্ষ শ্রমিক হওয়ায় তারা কাজের সুযোগ হারান। ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় নারী শ্রমিকদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা তৈরি পোশাক খাতে নারীরাই পিছিয়ে পড়ছেন। নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা এখন বেশি। অথচ দেশে তৈরি পোশাক কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যা দুই-ই বেড়েছে। বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, পোশাকশিল্প খাতে পুরুষ এখন ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ; বিপরীতে নারী আছেন ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। বিগত চার বছরের ব্যবধানে পোশাকশিল্প খাতে নারীর অংশগ্রহণ ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ কমেছে। নারীদের এই পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে নারীদের অদক্ষতা বা প্রযুক্তি ও দক্ষতায় ঘাটতিকে। এছাড়া বেতন বাড়ায় পুরুষদের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে তৈরি পোশাক খাতে (গার্মেন্টস) নারী শ্রমিকেরা পিছিয়ে পড়ছেন।
এছাড়াও বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা বিদেশে কাজ করতে গিয়ে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি ও নির্যাতনের শিকার হন, তা বর্ণনাতীত। বিশেষ করে সৌদি আরবে প্রায়ই নারীরা নির্যাতিত হন। অভিবাসন সম্পর্কে গত প্রায় তিরিশ বছরের হিসেবে, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কাছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে এই সময়কালে নারী শ্রমিকদের ৪০ শতাংশের গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে আলোচনা করলেও তাদের ভাগ্য বদলাতে এখনো কোনো কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
বর্তমানের করোনা পরিস্থিতি নারী শ্রমিকদের জীবনকে আরো মর্মান্তিক ও দুঃসহ করে তুলেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতে (আরএমজি) করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে এ শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বৈষম্য, হয়রানি, নারীদের কণ্ঠ রোধ, অসম মজুরি ও পারিবারিক বিধিনিষেধ বেড়েছে। এছাড়া অনেক নারী চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
নারী শ্রমিকদের এসব প্রতিকূলতা ও অসুবিধা দূর করা আবশ্যক। নারী শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য নারী শ্রমিকদের উপর হওয়া অসম আচরণ ও নির্যাতন বন্ধের জন্য নতুন ও সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নারী শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আলোকে কাজ করার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে তারা দেশকে উন্নতির পথে আরো বেগবান করতে তুলতে পারবে। তার সাথে উন্নত হবে তাদের জীবনযাত্রার মান।
ছবি: উবিনীগ এর ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ

Leave a Comment

Scroll to Top