বিশ্ব শ্রমিক দিবস: অভিবাসী শ্রমিক

লেখকঃ পূর্বাশা পৃথ্বী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, যুক্তরাজ্যে শিল্পের বৃদ্ধির পাশাপাশি স্পষ্ট হচ্ছে শ্রমের অভাব। তা্দের শ্রমিক আহবানে সাড়া দিয়ে কমনওয়েলথ দেশগুলো থেকে তরুণ শ্রমিক অভিবাসন শুরু হল। যুক্তরাজ্যের ক্রমবর্ধমান শ্রমের চাহিদা মেটাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এর তরুণরাও অভিবাসনে এগিয়ে এল। এরপর সত্তরের দশকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের খনি উদঘাটনের পর কর্মসংস্থানের সুযোগে বাংলাদেশ হতে শ্রমিক অভিবাসনের হার দ্রুত বাড়তে শুরু করল। আবার তখন থেকেই কেউ কেউ উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে অভিবাসী হয়েছেন। প্রতি বছর চার লক্ষাধিক কর্মী বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। পুরুষ শ্রমিকরা সংখ্যায় বেশী হলেও নারী শ্রমিকদের অভিবাসনও ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশ হতে শ্রমিক অভিবাসনের তালিকায় প্রথম পাচটি দেশ যথাক্রমে সৌদি আরব, মালয়শিয়া, কাতার, ওমান এবং সিঙ্গাপুর।
উন্নত জীবন কিংবা করমসংস্থানের আশায় দেশত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমালেও, অভিবাসী শ্রমিকদের জীবন সবসময় খুব সুখকর নয়। শ্রমিক নির্যাতন ও শোষণের ঘটনা শ্রম অভিবাসনের নতুন ঘটনা নয়। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে নানান নির্যাতনের শিকার প্রায় ৩০০০ নারীকর্মী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছে। সেফটি অ্যান্ড রাইটস এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত আট বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক দেশে ফিরেছেন লাশ হয়ে । এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বিদেশে বাংলাদেশি কোনো শ্রমিকের মৃত্যুর কারণও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা হয় না। এই অস্বাভাবিক মৃত্যু তদন্তে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস গুলোর উদ্যোগও সীমিত।
দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রতারক দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে অভিবাসী হয়ে নানান রকম জীবনের ঝুঁকির শিকার হন শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় এই প্রতারক গোষ্ঠীর খপ্পরে পরেন প্রতি বছর হাজার হাজার শ্রমিক। আন্তরজাতিক শ্রমিক সংস্থা অনুযায়ী প্রতারণার শিকার শ্রমিক ও বিদেশগামী শ্রমিক আইনি সহায়তা পাবেন, কিন্তু বিশাল অংশই এই সহায়তা পাননা। অবৈধ বিদেশি শ্রমিকদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের সাধারণত সেফ হোমে রাখা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই নীতির বাস্তবায়ন নেই।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট ৯টি মূল সনদের অন্যতম ‘অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রক্ষা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ’যা ১৯৯০ সালে গৃহীত হয়। অভিবাসীশ্রমিক প্রেরণকারী ৫৫টি রাষ্ট্রের এ সনদের পক্ষে অবস্থান হলেও অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী বা নিয়োগকারী কোনো রাষ্ট্রই এ সনদকে সমর্থন করেনি যেন সনদে বর্ণিত কোনো দায়-দায়িত্ব পালনেও তাদের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপিত না হয়।
এত সংগ্রামের মধ্য দিয়েও প্রবাসী শ্রমিকরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন, তা দেশের মোট রফতানি আয়ের অর্ধেক। কষ্টার্জিত উপার্জনের অর্থ নিয়মিত পাঠিয়ে তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভুমিকা রেখে চলেছে, যার অবদান মোট জিডিপির ১২ শতাংশের মতো।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মধ্যপ্রাচ্যের ও অন্যান্য শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলোতেও দেখা গেছে, অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ছিল না পর্যাপ্ত সহায়তা ও নিরাপত্তা। কোম্পানিগুলো প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই করায় এবং বেতন কাটায় বহু শ্রমিক উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য চাহিদা পূরণ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পরেছে। ফলে রেমিট্যান্সেও লক্ষ্য করা গেছে ঋণাত্মক প্রভাব।
অভিবাসী শ্রমিকদের এই দুর্দশা লাঘবের জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে সচেতনতা ও শিক্ষা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ। শ্রমিকগোষ্ঠীকে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে যেমন অবগত করা প্রয়োজন, তেমনি প্রতারক গোষ্ঠীর হাত থেকে রক্ষা পেতে অভিবাসনের সঠিক নিয়ম, আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে গ্রাম ও শহর পর্যায়ে সকল পরিবারকে সচেতন করা অপরিহার্য। প্রতারকগোষ্ঠীর শেকড় উৎপাটনের জন্য প্রশাসন ও জনগণ উভয়েরই তৎপর হওয়া আবশ্যক। বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের সাথে হওয়া অন্যায় প্রতিরোধে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর আরো বেশি তৎপরতা নিশ্চিত করা নাগরিক ও প্রশাসন উভয়েরই দায়িত্ব।
তথ্যসূত্রঃ
১। করোনাকালে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ভাবনা, ইমতিয়াজ আহমেদ সজল, দৈনিক বণিকবার্তা
২। অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব ও ভূমিকা, মো. জিল্লুর রহমান, দৈনিক মানবকণ্ঠ
৩। নিরাপদ অভিবাসন ও মানব পাচার সংক্রান্ত আইন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা – ২০১৫
৪। প্রবাসী শ্রমিক পাতা, প্রথম আলো
৫। “LABOUR MIGRATION FROM BANGLADESH 2018 – ACHIEVEMENTS AND CHALLENGES”, Tasneem Siddiqui, Marina Sultana, Rabeya Sultana & Sanjida Akhter
ছবিঃ সংগৃহীত

Leave a Comment

Scroll to Top