লিখেছেনঃ এনাম আহমেদ শুভ
“নিরাপত্তা সর্বাগ্রে” এমন একটি লেখার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। শ্রমিকদের বহু অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় বেতন বা মজুরি সম্পর্কিত দাবি। কিন্তু উপেক্ষিত থেকে যায় নিরাপত্তার কথাটি। শিল্প-কলকারখানার সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের মধ্যে নিরাপত্তার এই দিক নিয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই, নেই নিরাপত্তার পর্যাপ্ত উপকরণ সমূহ।
বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ও দূর্ঘটনার চিত্রঃ
বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষকে একসাথে কাজ করানোর প্রবণতা। অতিরিক্ত উৎপাদনের আশায়, বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, ফলে দূর্ঘটনা মোকাবেলা করার মত পরিস্থিতি থাকছে না, তৈরি হচ্ছে একটি অনিরাপদ কর্মক্ষেত্র। শ্রমঘন ভারি শিল্পাঞ্চল কিংবা তৈরি পোষাক শিল্পের কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখা আবশ্যিক হলেও অনাগ্রহের কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। একই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা ও নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষদের কথা। রপ্তানীখাতের অন্যতম চামড়া শিল্পের কথাও উল্লেখ করা যায়। বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাব থেকে দূরে রাখার উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে খুবই সীমিত। শিল্প অঞ্চলের অধিকাংশ শ্রমিকগণ স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো উপকরণ ব্যবহার করেন না। পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও যথাযথ নিরাপত্তা বিধান মেনে চলার প্রতি উদাসীন দেখা যায়।
প্রতিপালনীয় বিষয়সমূহকে অনুসরণ না করার ফলে প্রাণহানি ঘটছে প্রতিনিয়ত। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১৩৭ জন, আহত হয়েছিলেন ২৫০০ এর বেশি মানুষ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর গবেষণায় দেখা গিয়েছে শুধুমাত্র ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৭২৯ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন কর্মক্ষেত্রে দূর্ঘটনায়। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত ৭২৯ জন শ্রমিকের মধ্যে ৩৪৮ জন পরিবহনশ্রমিক, ৮৪ জন নির্মাণশ্রমিক, ৬৭ জন কৃষিশ্রমিক ও ৪৯ জন দিনমজুর। বিলস এর অপর আরেকটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে ২০০২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ১৫ বছরে ১৬৭৭ জন নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রপ্তানীমুখী ও স্থানীয় পোষাকশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানায় অগ্নিকাণ্ডের মোট সংখ্যা ১৩৫২ টি। পোষাকশিল্প ছাড়াও অন্য শিল্পকারখানাগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। ২০২০ সালে মোট ৩৮৩ টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সারাদেশের শিল্পকারখানায় সংঘটিত হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৪২৪৩ টি অগ্নিকাণ্ড কারখানাগুলোতে হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ প্রতিপালনীয় বিষয় সমূহঃ
কর্মক্ষেত্রের নিরাপদ পরিবেশ অনেকগুলো প্রতিপালনীয় (বা কমপ্লায়েন্স) বিষয়ের উপর নির্ভরশীল যেগুলো সরাসরি নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে জড়িত। ভবনের ত্রুটিমুক্ত নকশা, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা, সঠিক পদ্ধতিতে পণ্য মজুদ করণ, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি সরবরাহের লাইন সঠিকভাবে স্থাপন, কর্মক্ষেত্রে আলো বাতাস চলাচলের সঠিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করণ ইত্যাদি সকল কলকারখানা ও ভবনের জন্য প্রযোজ্য।
নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের নিরাপত্তার উপকরণ সমূহ সরবরাহ করা সেই নির্মাণের সাথে যুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অন্তর্ভূক্ত। জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ শ্রমিকদের এবং নির্মাণাধীন স্থাপনায় অবস্থানরতদের হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া, নির্মাণ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজের সময় নিরাপত্তা চশমা, বুট, গ্লাভস, এপ্রোন, সেফটি ভেস্ট পরিধান করার নির্দেশ রয়েছে। জাতীয় বিল্ডিং কোডে শ্রমিকদের ভবনের উচ্চ স্থানে কাজের সময় নিরাপত্তা বেল্ট পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
কারখানা ও ভবনে অগ্নিকাণ্ড রোধে ও অগ্নিকাণ্ডের সময় দূর্ঘটনা প্রশমনের জন্য নিরাপত্তা বিধান রয়েছে। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩ এর ৭ নং ধারা অনুযায়ী বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পূর্বে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক অনাপত্তি ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান রয়েছে।
প্রতিপালনীয় বিষয়সমূহ সঠিকভাবে অনুসরণ করে এমন কারখানার পরিসংখ্যান যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক নয়। ২০১৩-১৪ সালে ২২৪৫০ টি কারখানা পরিদর্শনের পর পরিদর্শন অধিদপ্তর ২০০০ টি কারখানার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করেছে যা মোট কারখানার ৮.৯% এই হার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উন্নীত হয়েছে ২১.২২% এ। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আইনগত দিক ও প্রতিপালনীয় বিষয় অনুসরণ করতে না পেরে ৫৯৮ টি কারখানা তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত পদক্ষেপ সমূহঃ
শ্রম আইন ২০০৬ ও ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯ এ নিরাপদ কর্মপরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে মোট ৪১ টি ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি এই আইনগুলোতে দূর্ঘটনাজনিত কারণে ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অসংগঠিত শ্রমিকদের কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ২০১৫ সালে অসংগঠিত শ্রমিক কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা (অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত) আইন প্রণীত হয়। গৃহকর্মে নিযুক্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ও কল্যাণার্থে আইন প্রণয়নের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ২০১৫ সালে প্রণীত হয়েছে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ২০১৬ সালে শ্রম পরিদর্শন সংক্রান্ত জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ণ করে। যার প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে বর্ণীত হয়েছে পরিদর্শন ব্যবস্থার মাধ্যমে শোভন কর্মপরিবেশ তৈরি করা ও শ্রমিকদের কার্যকর সুরক্ষা প্রদান করা। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এর বিধান অনুযায়ী যেসকল কারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৫০ বা তার অধিক শ্রমিক নিয়োজিত আছে, তাঁদের সেইফটি কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক। রপ্তানীমুখী পোষাক শিল্প কারখানায় অগ্নি নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত অখণ্ডতা নিশ্চিতকরণে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দূর্ঘটনার পরবর্তীতে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ গঠন করা হয়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০১০ সালে শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা প্রণয়ন করে। মন্ত্রণালয়ের ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে ৩৮ ধরণের কাজকে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনের জন্য গৃহীত পদক্ষেপের তৃতীয় পর্যায়ে ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
২০১৮ সালে রাজশাহীতে জাতীয় পেশাগত ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট নির্মাণের কাজ শুরু হয়। অপরদিকে, শ্রমিকদের পেশাগত রোগের চিকিৎসার জন্য গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এ ২৭৫ ও ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট ২টি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানের শোভন কর্মক্ষেত্র ও নিরাপত্তা বিধি থেকে আমরা কতটা পিছিয়ে?
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মোট ১৯০ টি কনভেনশন রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে মাত্র ৩৫ টি। কিন্তু পেশাদার স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ সংশ্লিষ্ট কনভেনশন এর মধ্যে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে মাত্র চারটি। ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা প্রণীত পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কনভেনশনে বাংলাদেশ এখনও অনুস্বাক্ষর করেনি। এছাড়াও, বিভিন্ন খাত ভিত্তিক নিরাপত্তা বিধান সংশ্লিষ্ট কনভেনশনে বাংলাদেশ এখনও অনুস্বাক্ষর করেনি।
নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের অর্থনীতিঃ
নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের অর্থনৈতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। প্রতিষ্ঠানের স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী লাভ সম্ভব হয় নিরাপদ ও শোভন কর্ম পরিবেশ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক তথা কর্মীদের কর্মস্থল ত্যাগের হার (টার্নওভার রেট) কমে আসে, দূর্ঘটনাজনিত ছুটির পরিমাণ কম হয়। অপরদিকে, কর্মপরিবেশে নিরাপত্তা না থাকলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম (গুডউইল) ও খ্যাতি (ব্র্যান্ড ভ্যালু) কমে আসে।
শিল্পকারখানার অগ্নিকাণ্ডে আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পোষাকশিল্প ও অন্যান্য শিল্পকারখানায় ঘটে যাওয়া ৫৯৭৮ টি অগ্নিকাণ্ডে মোট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৯২০ কোটি টাকার উপরে। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ লাখ টাকার বেশি। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করার কারণে প্রতিষ্ঠানদের পড়তে হচ্ছে আইনগত জটিলতার মুখে।
রানা প্লাজা থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাঃ
রানা প্লাজার মত ঘটনায় শ্রমিকদের নিরাপত্তার অধিকার নিয়ে সরব হয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। নেতিবাচক সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ নিরাপদ কর্ম পরিবেশের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্য অর্জনে শুধু সরকারের প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়, কাজ করতে হবে প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থদেরও। আর শ্রমিকদেরও তাঁদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃজনে ভূমিকা রাখতে হবে।
ফিচারড ইমেজঃ Racked