বিশ্ব পরিবেশ দিবস: সমুদ্র দূষণ ও আমাদের করণীয়

লিখেছেনঃ সাহিল সাদ

“Thousands have lived without love, not one without water.”
– W.H.Auden

পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় ৭৫ শতাংশ জল। মানবদেহের ৬০-৭০% পানি দিয়ে তৈরি। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানবদেহের দৈনিক ৩-৪ লিটার পানি প্রয়োজন। সৃষ্টির অপর নামই যেন পানি। শুধুমাত্র দৈহিক প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও খাদ্য উৎপাদন, দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ সহ মানব জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে পানির অপরিসীম অবদান। নদীনালা, খালবিল, পুকুর, ভূগর্ভস্থ পানি এবং সমুদ্র থেকে আমরা আমাদের পানির চাহিদা পূরণ করি। কিন্তু আমাদের অসচেতনতার কারণে যখন পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন ঝুঁকির মুখে পড়ে পুরো মানবজাতি।
“Even if you never have the chance to see or touch the ocean, it touches you with every breath you take, every drop of water you drink, every bite you consume. Everyone, everywhere is inextricably connected to and utterly dependent upon the existence of the sea.”
– Dr. Earle

মানবজীবনের সাথে সমুদ্রের নিবিড় এক সম্পর্ক বিরাজমান। পৃথিবীতে প্রাপ্ত পানির প্রায় ৯৬.৫% পাওয়া যায় সাগর এবং মহাসাগরে। যদিও লবনাক্ত হওয়ার কারণে সমুদ্রের পানি পানযোগ্য নয় তবুও পানি চক্র, খনিজ লবণের চাহিদাপুরণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সমুদ্রের জলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবুও মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিনিয়ত সমুদ্রের ক্ষতিসাধন হচ্ছে যার মধ্যে অন্যতম হলো: প্লাস্টিক, কলকারখানার বর্জ্য, তেল দূষণ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্তের সাথে যুক্ত আছে ভারত মহাসাগরের সম্প্রসারিত অংশ যা বঙ্গোপসাগর নামে পরিচিত। প্রায় ২২ লক্ষ বর্গ কিমি আয়তনের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই সাগরের গড় গভীরতা প্রায় ২,৬০০ মিটার। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার সাথে যুক্ত থাকা বঙ্গোপসাগরের রয়েছে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ও যোগাযোগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

আসুন জানার চেষ্টা করি, কীভাবে আমরা প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের ক্ষতিসাধন করছি এবং তা রোধে কী ধরণের সচেতনতা প্রয়োজন।
প্লাস্টিক বর্জ্য : সমুদ্র দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ। ২০১৮ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা UNEP থেকে ‘বিশ্বের প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন নদী ও শাখানদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণগত দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম। এই প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থ সমুদ্রের সৌন্দর্য্য নষ্টের পাশাপাশি সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানের ক্ষতিসাধন করে। প্লাস্টিক কণাকে খাদ্য ভেবে মাছ তা গ্রহণ করে এবং ফলশ্রুতিতে বিষাক্ত প্লাস্টিকের নানা রোগে আক্রান্ত হয়। গবেষণামতে প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ গলাধঃকরণ করায় সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন বাঁধাগ্রস্ত হয়।
এই যে প্রতিনিয়ত সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক দ্রব্য জমা হচ্ছে এর পেছনে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা অন্যতম কারণ। কেননা সাধারণ মানুষের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক দ্রব্য নদীনালার মাধ্যমে বাহিত হয়ে সমুদ্রে পৌঁছায়। তাই আমরা যদি পরিকল্পিতভাবে প্লাস্টিক দ্রব্য recycling প্রক্রিয়ার জন্য সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করি তাহলে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ : কলকারখানাগুলো সাধারণত নদী কিংবা খালের আশেপাশে তৈরি করা হয় যেন সহজেই বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে যে সমস্যা ঘটে সেটা হলো এই বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে কোন বিধিনিষেধ মান্য করা হয় না। যার কারণে অপরিকল্পিতভাবে বর্জ্য পদার্থগুলো নদীনালার জলের সাথে বাহিত হয়ে একসময় সমুদ্রে জড়ো হয়। এই বর্জ্য পদার্থগুলোর মধ্যে থাকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যেমন: পারদ, সীসা ইত্যাদি। এইসকল পদার্থ সমুদ্রে থাকা জীবের দেহে প্রবেশ করে বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

কলকারখানার বর্জ্য অপসারণে যেন নীতিমালা মেনে চলা হয় এই বিষয়ে সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসনের সচেতন থাকা অতীব জরুরী। আমাদের আশেপাশের এলাকায় হয়তো এমন কলকারখানা থাকতে পারে যা নদীর সাথে যুক্ত। সেই কলকারখানার বর্জ্য নিয়ম মেনে অপসারিত হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে আমরা লক্ষ রাখতে পারি।

সামুদ্রিক জাহাজের বর্জ্য : বাংলাদেশে মোট ৩টি সমুদ্র বন্দর রয়েছে। এই সমুদ্র বন্দরে প্রতিনিয়ত বিপুল সংখ্যক জাহাজ আসা যাওয়া করে। জাহাজে থাকা বিভিন্ন ধরণের বর্জ্য পদার্থ কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই যেখানে সেখানে নিষ্কাশিত করা হয়। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাফিক সূত্র হতে জানা যায়, ২০০০১-২০১৮ সাল এর জুলাই পর্যন্ত ৫ হাজার ৩২৫টি দেশি-বিদেশি জাহাজ বন্দরে আসা-যাওয়া করেছে। তাহলে প্রতি বছর গড়ে ২০০ এর অধিক জাহাজ মোংলা বন্দরে আসা-যাওয়া করে। প্রতি জাহাজ থেকে সর্বনিম্ম ১০- ১৫ টন জ্বালানি বর্জ্য পশুর নদী ও সাগরে ফেলা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছরে প্রায় ২ হাজার টন জ্বালানি বর্জ্য সাগর উপকূলে নিক্ষেপ করা হয়।

১৯৭৩ সালের বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধি থাকলেও বেশিরভাগ সময় সেগুলো মানা হয় না। কর্তৃপক্ষ যেন নিয়মনীতি পালনে সচেষ্ট হয় সেই বিষয়ে প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে কেননা এইভাবে বঙ্গোপসাগরের দূষণ ঘটতে থাকলে অচিরেই সমুদ্র তার বৈচিত্র্যতা হারাবে।

বিখ্যাত পরিবেশবাদী নেতা Robert Swan বলেছিলেন,
“The greatest threat to our planet is the belief that someone else will save it.”

এই পৃথিবী আমাদের তাই এই পৃথিবীকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের। কেননা আমাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট অবহেলার কারণে সমুদ্র প্রতিনিয়ত ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছে। দৈনন্দিন বর্জ্য পদার্থ ফেলার সময় আমাদের আরো বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এর পাশাপাশি সমুদ্রের সাথে জড়িত যেন কঠোরভাবে পালিত হয় সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। আমরা যারা এই মুহূর্তে বেঁচে আছি তারা হয়তো একসময় এই পৃথিবীতে থাকবো না। কিন্তু সমুদ্রকে আমরা যেভাবে পেয়েছি তার থেকেও সুন্দরভাবে নতুন প্রজন্মকে উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই।

*Image source : pixabay.com

1 thought on “বিশ্ব পরিবেশ দিবস: সমুদ্র দূষণ ও আমাদের করণীয়”

  1. আবুল কালাম আযাদ

    আমি সরকারি চাকুরিজীবী কিন্তু পরিবেশ দুষণ রোধে কাজ করতে আগ্রহী। পৃথিবী ও আমার দেশকে রক্ষার জন্য আমি কাজ করতে চাই।
    আমার মেইল নম্বর razumia78@gmail.com
    phone-01912943052
    নাম: আবুল কালাম আযাদ

Leave a Comment

Scroll to Top