বিশ্ব পরিবেশ দিবস: বায়ু দূষণ

লিখেছেনঃ মাইশা মালিহা
আজ ৫জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশকে তার প্রতিনিয়ত হতে থাকা বিপর্যয়ের দ্বার থেকে রক্ষা করতে এবং বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭৪ সাল থেকে বিশ্বপুঞ্জকর্তৃক প্রতিবছর ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলাদেশসহ প্রায় ১৫০টি দেশে পালিত হয় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। প্রকৃতি জীবের জীবনধারক, প্রকৃতিকে অবলম্বন করেই বিকশিত হয়েছে মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও অন্যান্য সকল জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব কিন্তু প্রতিনিয়ত মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে এই পরিবেশ হয় নানাভাবে দূষিত। বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণের অন্যতম ও উল্লেখযোগ্য হুমকিগুলোর একটি হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে হওয়া বায়ুদূষণ এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, যার ফলশ্রুতিতে ঘটছে জলবায়ুর ত্বরানিত পরিবর্তন।
গত ৭ বছরের মধ্যে এবছর এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের তাপপ্রবাহ ছিল সর্বাধিক। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে পরিচালিত একটি গবেষণা অনুযায়ী জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকা সহ বাংলাদেশের আরও ৪টি জেলা- রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং খুলনা এই ৫টি জেলার বড় শহরগুলো বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠবে। গবেষণা অনুযায়ী দেখা যায়, গত ২০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস যেখানে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রাবৃদ্ধিকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য লড়াই চলছে প্রতিনিয়ত। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান গবেষক মি. দেওয়ান দায়ী করেছেন যে কারণগুলোকে তা হলো- অরণ্যনিধন, বনভূমি উজাড়, জলভূমি ভরাট, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ণ ও অধিক জনসংখ্যাকে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) অনুযায়ী, গড় প্রতিবছর বাংলাদেশে অরণ্যনিধনের হার প্রায় ২.৬%, গ্লোবাল এভারেজ অনুপাতে যা প্রায় দ্বিগুণ। রেইনফরেস্ট ফাউন্ডেশন নরওয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে বাংলাদেশের প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটারের একটি ক্রান্তীয় অতিবৃষ্টি অরণ্য (Tropical rainforest) নিধন করা হয়েছে, যা আকারে প্রায় ঢাকার নারায়নগঞ্জ শহরের সমান। এছাড়াও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার ২০২০ সালের বিশ্বের বায়ুর মানের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে পর্যায়ক্রমে পাকিস্তান ও ভারত। বাংলাদেশের বায়ুতে শনাক্ত করা যায় পিএম-২.৫ বা প্রাণঘাতী পার্টিকুলেট ম্যাটার এর উপস্থিতি, যা উপস্থিতি প্রায় প্রতি ঘনমিটারে ৭৭.১% যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে প্রায় দেওয়া সীমার চেয়ে সাত গুন বেশি। এক জরিপে অনুযায়ী দেখা যায়, ঢাকার বায়ুতে এইসব অসহনীয় মাত্রায় ভয়াবহ ধাতুর উপস্থিতির জন্য ঢাকার অপরিকল্পিত ইটের ভাটাগুলো ৫৮ শতাংশ দায়ী। তাছাড়া ফিটনেসবিহীন প্রায় ৫ লাখ যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ প্রতিনিয়ত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশকে করছে দূষিত।
এছাড়াও সম্প্রতি এবছর কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত চিত্রে ঢাকার বেশকিছু অঞ্চল থেকে বর্ণহীন,গন্ধহীন এবং গ্রীনহাউজ গ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হুমকিস্বরুপ গ্যাস মিথেনের বিশাল নিঃসরণ চিহ্নিত করা হয়েছে। মিথেন, একটি বর্ণহীন, গন্ধহীন গ্রিনহাউজ গ্যাস যা গ্রিনহাউজ গ্যাসের তালিকায় সর্বোচ্চে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা প্রায় ৩০ গুণ বেশি ধরে রাখতে পারে যার ব্যপ্তি প্রায় এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত হতে পারে। গত ২০ বছরে কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে পরিবেশের ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে মিথেন। কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডল উষ্ণায়নে দীর্ঘ সময় নেয়। পক্ষান্তরে, মিথেন উষ্ণায়ন ঘটায় স্বল্প সময়।সম্প্রতিসময়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ২৫% হয়ে থাকে মানবকর্মকাণ্ডে সৃষ্ট এই মিথেন গ্যাসের মাধ্যমে। এমতাবস্থায়,আমাদের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য মিথেন নিঃসরণের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হওয়া একটি উদ্বেগপূর্ণ সংবাদ। চলতিবছর এপ্রিলেই বিশ্বখ্যাত নিউইয়র্কভিত্তিক আর্থিক ও ডেটাসেবা প্রদানকারী এবং মিডিয়া কোম্পানি ব্লুমবার্গ, জিএইচজিস্যাট ইনকের বরাতে বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে মিথেন গ্যাসের উচ্চমাত্রার উপস্থিতির খবর প্রকাশ করে। প্রকাশিত সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী জিএইচজিস্যাট এর প্রেসিডেন্ট স্টিফেন হারমেইন জানিয়েছেন, গত ১৭ এপ্রিল তাদের হুগো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ঢাকার সবচেয়ে বৃহৎ ময়লার ভাগাড় মাতুয়াইলে তারা মিথেনের এই বিপুল উৎসের সন্ধান শনাক্ত করেন। তাদের ধারণা মাতুয়াইলের ময়লার ভাগাড় থেকে প্রতি ঘন্টায় ৪ টন মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশে যাচ্ছে, যা পরিবেশে প্রায় এক লাখ নব্বই হাজার গাড়িকর্তৃক বায়ুদূষণের সমান দূষণ ঘটায়। চলতিমাসেই ফ্রান্সের কোম্পানি কায়রোস এএএস বাংলাদেশের উপরে ১২টি সর্বোচ্চ মিথেন নিঃসরণের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করে, যা জিএইচজিস্যাট পরে নিশ্চিত করে। এছাড়াও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ডেটা বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ব্লুফিল্ড টেকনোলজিসও বাংলাদেশের উপরে এই গ্যাস শনাক্ত করে। বাংলাদেশের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ নিয়ে অনেকদিন যাবতই কাজ করে চলেছিল এই মন্ট্রিল-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিএইচজিস্যাট। এই প্রথমবারের মত তারা একটি নির্দিষ্ট উৎস চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। মাতুয়াইলের এই বিশাল সংখ্যক পচনশীল বর্জ্য হতে উৎপন্ন মিথেন যদিও মিথেনের নিঃসরণের একটি বিশাল উৎস বটে, তবুও পুরো শহরের উপর শনাক্ত এই বৃহৎ, দীর্ঘস্থায়ী এবং বিস্তৃত নিঃসরণকে ব্যাখা করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই স্টিফেন জানিয়েছেন তারা এ নিয়ে পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখবেন।
১৮১ একরের মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিলে দিনপ্রতি প্রায় ২৫০০ টন বর্জ্য গ্রহণ করা হয়। ২০১৮-১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী দুই সিটি কর্পোরেশনের বাসাবাড়ির ময়লা থেকে শুরু করে সবধরনের বর্জ্য মিলিয়ে এটার সম্পূর্ণ এমাউন্ট ছিল প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার টন। এর মধ্যে তরল বর্জ্য এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপন্ন করে এমন অনেক বর্জ্য রয়েছে, তবে সেখান থেকে ঠিক কতটুকু পরিমাণে মিথেন উৎপন্ন নয় সে নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়্নি। অপরদিকে দিনপ্রতি প্রায় ৭০০০ টন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জায়গা সংকুলণে ২০১৯ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সিদ্ধান্ত নেয় ‘মাতুয়াইল স্যানিটারি ল্যান্ডফিল সম্প্রসারণসহ ভূমি উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করবে। যার লক্ষ্য ছিল বিপুল পরিমাণের এই বর্জ্যকে কাজে লাগানো এবং তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। যেটি এতদিনে বাস্তবায়িত হয়ে যাওয়ার কথা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের এই বিপুল পরিমাণে বর্জ্যও পোড়ানো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে এই বিশাল সংখ্যক বর্জ্যদাহের ফলেই কি ঘন্টায় চার হাজার কেজি বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে কিনা কিংবা প্রতিদিন মাতুয়াইলের ভাগাড় থেকে ঠিক কি পরিমাণে মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে এবং তা থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, কাজে লাগানো যায় বা তা কিভাবে নিষ্কাশন করা যায় সেটা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা এখন অত্যন্ত আবশ্যক, নাহলে মাতুয়াইলের এই বিপুল পরিমাণে বর্জ্যপচন ও বর্জ্যদাহ থেকে উৎপন্ন এই উচ্চমাত্রার মিথেন আমাদের মত সমুদ্র তীরবর্তীদেশের জন্য অদূর ভবিষ্যতে নিয়ে আসতে পারে ভয়াল বিপদ।
ছবিঃ সমকাল

Leave a Comment

Scroll to Top