কৃষ্ণ গহবর আবিস্কারের নৈপথ্যে আলোকিত যারা

কোপারনিকাস, জিওর্দানো ব্রুনো ও গ্যালিলিওর মতো উচ্চাবিলাসী ও আকাশপ্রেমিদের চোখেই সর্বপ্রথম মহাকাশ একটি বৈজ্ঞানিক রুপে মানুষের কাছে ধরা দেয়। এরপর বিগত ৫০০ বছরে বিজ্ঞানের অকল্পনীয় যাত্রা ও অসংখ্য বিজ্ঞানীর নিরলস পরিশ্রম এবং ত্যাগের মাধ্যমে নিরেট কালো মহাকাশে লুকানো অসীম রহস্যের অনেক অজানা তথ্য মানুষের কাছে ধরা দিয়েছে। এতদিন  মহাকাশ গবেষক এবং পদার্থবিদদের তত্ত্ব ও আলোচনার অন্যতম প্রধান একটি বিষয় ছিলো ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের অস্তিত্ব। এবছর এই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে নিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৯ বছর বয়সী অধ্যাপক রজার পেনরোজ।  আর আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে এরকমই একটি ব্ল্যাকহোলের অবস্থান নির্ণয় করে জার্মানীর ‘ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউট ফর এক্সট্রা টেরেস্টিয়াল ফিজিক্সে’ কর্মরত রেইনহার্ড গেঞ্জেল ও  উইনিভার্সিটি অব ক্যালেইফোর্নিয়ার অধ্যাপক আন্দ্রে গেজও পেনরোজের সাথে যৌথভাবে অর্জন করেছেন পদার্থে নোবেল পুরস্কার বিজয়ের সম্মান।

“এবছরের পুরস্কারটি হচ্ছে মহাবিশ্বের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন অজানা বিষয়গুলোকে নিয়ে”- নোবেল ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রধান গোরান কে হ্যানসন এই কথা বলে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এইবারের নোবেলটি হতে যাচ্ছে কৃষ্ণ গহ্বরময় । আর অক্টোবরের ৬ তারিখ বিজয়ীদের নাম ঘোষনা করে নোবেল কমিটি নিজেদের আগাম আভাসের সত্যতাই প্রমাণ করেছে।

আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব হতে সর্বপ্রথম ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের ধারণাটি  বৈজ্ঞানিক মহলে উঠে আসে।  এর অস্তিত্ব এবং অবস্থান নিয়ে বিজ্ঞানীদের জল্পনা-কল্পনা ও আলোচনার শুরুও এরপর থেকেই। অবশেষে রজার পেনরোজ গাণিতিকভাবে নির্ভুল হিসাব করে প্রমাণ করে দেখান যে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিকভাবেই সম্ভব। তার এই অবদানের জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক সম্মানী প্রায় ১.১ মিলিয়ন ডলার পাবেন।

পুরস্কারের অবশিষ্ট অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিবেন রেইনহার্ড গেঞ্জেল এবং আন্দ্রে গেজ । নিজ নিজ গবেষনায় তারা প্রমাণ করেছেন এরকম একটি ব্ল্যাক হোল আমাদের ছায়াপথ মিল্কওয়ের কেন্দ্রেই অবস্থান করে। এই ব্ল্যাক হোলটির নাম ‘’স্যাজিটিরিয়াস এ*’। আয়তনে এটি সূর্যের থেকেও ৪০ লক্ষ গুণ বিস্তৃত।

এইবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলবিজয়ীদের কাজ নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য খুলে দিয়েছে এক অসীম অজানা জগতের পথ । মিল্কিওয়েতে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে মাত্র চতুর্থ নারী হিসেবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী আন্দ্রে গেজ বলেন, “প্রথম বিষয়টি হচ্ছে অনুসন্ধান। তোমার নিজেকে আগে বিশ্বাস করাতে হবে তুমি আসলেই সেটা দেখছো যেটা তুমি ভাবছো তুমি দেখছো। অনুসন্ধান এবং উৎসাহ।”

নিজেদের এই আবিষ্কার ও নোবেল বিজয়ের পেছনের গল্পটাও খুব অল্প সময় বা অল্প পরিশ্রমের নয়। পেনরোজ বিগত প্রায় ৫০ বছরে ধরে কাজ করে যাচ্ছেন ব্ল্যাক হোলের গাণিতিক অস্তিত্ব প্রমাণে। প্রায় অর্ধযুগ আগে স্টিফেন হকিং এর সাথে মিলে  যৌথভাবে তিনি কাজ করেন ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি নির্ণয়ে। নোবেল ফাউন্ডেশন তাদের বিবৃতিতে জানায়, “পেনরোজের আবিষ্কারের মাধ্যমেই ব্ল্যাক হোল ধারণাটি এই নামে স্থায়িত্ব অর্জন করে।”

আন্দ্রে গেজ ও রেনফিল্ড গেঞ্জেলের আবিষ্কারের গল্পটিও বিষ্ময়কর। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অভ্যন্তরে রহস্যজনক কোনো তীব্র আকর্ষণী বস্তুর অস্তিত্ব আবিষ্কারে দুজনেই পৃথক পৃথক নিরীক্ষনের ব্যবস্থা করেন। গেজ যুক্তরাষ্টের হাওয়াই এবং গেঞ্জেল চিলিতে শুরুতে করেন তাদের আবিষ্কারের যাত্রা।  বিশাল বিশাল টেলিস্কোপের মাধ্যমে চালিয়ে যান নিজেদের গবেষনার কাজ। তবে পৃথিবী থেকে ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূর মিল্কিওয়ের কেন্দ্র এবং কেন্দ্রকে আবর্তন করা অসংখ্য তারকার মাঝ থেকে নির্দিষ্ট কিছু নক্ষত্রের গতবিধি পর্যালোচনা পারতপক্ষেই অসম্ভব কঠিন একটি কাজ। এই কঠিন কাজে সফল হতে বিজ্ঞানীদের বছর নয় বরং একাধিক দশক সময়  লেগে যায়।

 

Author : Mohammad Sifat
Authors Bio : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Comment

Scroll to Top