শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানিঃ এ মহামারীর শেষ কোথায়?ঠেকাবে কে?

লিখেছেনঃ সামিয়া তাহসীন হক এবং আফরিনা আসাদ

সাম্প্রতিককালে, বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ বুয়েটের ৪ জন শিক্ষার্থী একই প্রতিষ্ঠানের একজন ছাত্রীকে চূড়ান্ত যৌন হয়রানি করে ব্যাপক আলোচনা এবং সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। অভিযুক্তরা হলেন- 

১। জারিফ হোসাইন

২। সালমান সায়ীদ

৩। জারিফ ইকরাম

৪। জায়ীদ মানোয়ার চৌধুরি

দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহপাঠীদের দ্বারা নারীর প্রতি এইধরনের সহিংসতা নতুন কিছু নয়। বরং এই ঘৃণ্য অপরাধের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি আমাদের জানান দেয় যে নারীর জন্য একটি নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা ঠিক কতখানি ব্যর্থ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অভিযুক্তদের পাশাপাশি আর কোন কোন কারণ দায়ী আমাদের শিক্ষার্থীদের চরম নৈতিক অবক্ষয়ের পিছনে? 

এর পেছনের কারণগুলোকে আমরা ৫টি ভিন্ন দিক থেকে এপ্রোচ করতে পারি-

১) নারীকে বস্তু বা অবজেক্ট ভাবা

২) ইনস্টিটিউশনাল প্রাইড 

৩) লকার রুম টক 

৪) ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স

৫) পর্যাপ্ত এবং সঠিক সেক্স এডুকেশনের অভাব 

নারীকে বস্তু বা অবজেক্ট ভাবা

অভিযুক্তদের কথোপকথনে আমরা দেখতে পাই, ভিকটিম যতবারই অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন তারা আমলে নেননি। অর্থাৎ, নারীর মতামত তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণভাবে নেয়ার মত কিছু মনে হয় নাই। কারণ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষদের মাথায় গেঁথে দেয় যে নারীর ‘না’ মানে আসলে ‘না’ নয়।  একারণেই তারা মনে করে শুধুমাত্র তাদের তথাকথিত লৈঙ্গিক সুপিরিয়রিটির কারণে তারা নিজেদের মতামত নারীর উপর চাপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। এর উদাহরণ হচ্ছে ‘গাড়ি, বাড়ি, নারী’ এইধরনের কুরুচিপূর্ণ বাক্য উঠতি বয়সীদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া। যার ফলে তারা নারীকে অবজেক্ট ভাবতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে জীবনের বিভিন্ন ধাপে তাদের দ্বারা নারী সহকর্মীরা, সহপাঠীরা অবজেক্টিফায়িং এর শিকার হতে থাকেন।

 ইনস্টিটিউশনাল প্রাইড 

আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা ‘ইনস্টিটিউশনাল প্রাইড’ নামক ব্যধিতে ভোগেন। তারা মনে করেন যেহেতু তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠগুলোর শিক্ষার্থী সেহেতু তারা অন্যদের চেয়ে সুপিরিয়র এবং এর কারণে তাদের যেকোনো কর্মকাণ্ড জাস্টিফাই করা হবে। এই অযৌক্তিক অহংকার ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদেরকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। আদতে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশ হলেই কোন ব্যক্তি যে মানুষ হিসেবে ভালো হবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই- এর জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে সাম্প্রতিককালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত হওয়া যৌন হয়রানির ঘটনাসমূহ। 

লকার রুম টক

লকার রুম টক বা Guy Talk হচ্ছে প্রচন্ড টক্সিক একটি পরিবেশ যেখানে প্রতিনিয়ত মিসোজিনি এবং সেক্সিজমের চর্চা করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অফিস আদালত পর্যন্ত সবখানেই এর উপস্থিতি বিদ্যমান। বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা ভার্চুয়াল মাধ্যমে নারীকে নিয়ে অপ্রীতিকর, অযাচিত, অশোভন এসব আলোচনা বা উক্তি নারীর প্রতি পরোক্ষ সহিংসতারই বহিঃপ্রকাশ। এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই অভিযুক্তদের গ্রুপচ্যাটে- যেখানে তাদের এক অন্যকে দেয়া উস্কানিমূলক বার্তা ভিক্টিমের সাথে অপরাধটি সংঘটনের মূল জ্বালানী হিসেবে কাজ করেছে। 

ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স

“ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স” টার্মটি প্রথম ব্যবহার করেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। এটির ব্যাখ্যা হচ্ছে – পুরুষরা নারীকে কেবল দুটি রূপেই কল্পনা করতে পারে; হয় ম্যাডোনার মত পবিত্র, দেবীরূপে অথবা একজন পতিতা বা হোর রূপে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের সফলতার মাপকাঠি হচ্ছে তিনি কতটুকু ভালো মা, বোন বা স্ত্রী- এই প্যারামিটারে। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই যেসব নারী এই প্যারামিটারে ওয়েল-ফিটেড না হন, তাদের সবাইকে অহেতুক হিউমিলিয়েট করাটা পুরুষরা নিজেদের অধিকার ভাবেন। ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্স একই সাথে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আমাদের সমাজে যৌনকর্মীদের সাধারণ সম্মানেরও যোগ্য ভাবা হয় না। 

পর্যাপ্ত এবং সঠিক সেক্স এডুকেশনের অভাব

বয়সন্ধিকালে সঠিক এবং পর্যাপ্ত যৌনশিক্ষার অভাব এই ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পেছনে অনেকাংশে দায়ী। নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবেই তীব্র থাকে। নারী ও পুরুষের যোগাযোগের সহজ বিষয়গুলোকে ট্যাবু হিসেবে রাখার ফলে  স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এভাবেই বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটনের বীজ সামাজিকভাবেই বুনে দেওয়া হয়৷ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর এক গবেষণায় পাওয়া যায় অংশগ্রহণকারি নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে ৯৪% পুরুষ শিক্ষার্থী দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে এবং ২০ শতাংশ শিক্ষক দ্বারা। (১)

এই সংখ্যা থেকেই দেশের সামগ্রিক চিত্র অনুমান করে নেয়া যায়। হাইকোর্টের নির্দেশ আছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রুখতে একটি কমিটি গঠন করতে, যা হয়তো কিছুটা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিচার বাস্তবায়ন করতে পারতো। 

মহামারির মতন ছড়িয়ে পড়া এই ব্যাধি নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ কবে হবে?

 স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা প্রতিরোধ ও প্রতিকার চাওয়াটা শিক্ষার্থীদের অধিকার এবং প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। 

* কমিটি ও নীতি নির্ধারনঃ শুধু চার দেয়াল আর লেকচার দিয়েই শেষ নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর নিজস্ব নীতি বা পলিসি থাকা চাই হয়রানি রোধে। প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কমিটি গঠন করতে হবে। যে কমিটির কাজ হবে ক্যাম্পাসে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি ও সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা। সেটা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সবখানে হতে হবে। 

* প্রশিক্ষণ ছাড়া নিয়োগ নয়ঃ শুধু কমিটি করেই ক্ষান্ত হলে চলবেনা। হয়রানিমূলক কর্মকান্ড কিভাবে পরিচালনা করতে হয়, ভিক্টিমের সাথে কথা বলতে হয়, পদক্ষেপ নিতে হয়, ভিক্টিম কে যেন ট্রমাটাইজ না করা হয়, এ ব্যাপারে কমিটির প্রতিটি মানুষকে, শিক্ষকদের, কর্মচারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ভিক্টিমের সহায়তায় যেন সার্বক্ষনিক সমর্থন দেয়ার মতন জনবল ও হটলাইন থাকে। এই হটলাইনে যেকোন সময় সাহায্য পাওয়া যাবে। 

* ভিক্টিম বান্ধব সিস্টেমঃ ভিক্টিমের পরিচয় গোপন করে ও সহজে ঝামেলা এড়িয়ে অভিযোগ করা যায় এমন ব্যবস্থা করতে হবে। সবচেয়ে ভালো উপায় হল অনলাইনে গোপনীয়তা রক্ষা করে অভিযোগ করার সুযোগ তৈরি করা। যা ইতোমধ্যে উন্নত বিশ্বে দেখা যায়। ভিক্টিমকে দোষারোপ না করা, পরিচয় গোপন করা, দ্রুত শাস্তি, এবং অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্তর পরিচয় রক্ষা এই চার বিধানের সমন্বয়ে কাজ করবে প্রতিরোধ কমিটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় আরো উঠে আসে বিভিন্ন কারণে ভিক্টিমের বিচার না চাওয়ার পেছনের কারণ গুলো হলঃ অভিযোগ কেউ বিশ্বাস করবেনা এমন ভয়, ঝামেলা বা জানাজানির ভয়, পরীক্ষায় নাম্বার কমিয়ে দেয়ার আশংকা, রাজনৈতিক ক্ষমতার কারণে দুর্নীতি গ্রস্থ আইনি ব্যবস্থা। (১)

Image source: The Guardian

সবার সমর্থন ও অন্তর্ভুক্তিঃ  যৌন হয়রানিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চিহ্নিত করা যাবেনা। বরং ক্যাম্পাসের সবার সমর্থনে ও সাহায্যে সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছুদিন পর পর শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবককে তাদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে জানাতে হবে। কি করে ভিক্টিম কে সহযোগিতা করা যায়, নিজ নিজ স্থান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, শাস্তি ও অভিযোগের নিয়মগুলো কি কি এসব সকলকে নিয়মিত জানাতে হবে।নিজস্ব ওয়েবসাইটে ও সকলের হাতের নাগালে বিস্তারিত বর্ণনা এবং সাহায্য পাওয়ার উপায়গুলো উল্লেখ করা থাকবে।  যৌন হয়রানি নিয়ে কাজ করছে এমন সংস্থার সাথে সংযুক্ত হতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। যাদের মাধ্যমে প্রাথমিক সহায়তা ও সার্বক্ষনিক জবাবদিহিতা নিশ্চয়তা দেয়া যেতে পারে।

এমন বিস্তারিত ও ভিক্টিম বান্ধব নীতি তৈরি না করে, বছরের পর বছর সুষ্ঠু বিচার না দিয়ে যদি লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের হয়রানিতে ফেলে দেয়া হয়, তাহলে হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় না করা ছাড়া বিচার চাওয়ার আর কোন সুযোগ থাকবেনা।

 নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সাম্প্রতিক ঘটনার পর সারা বছর ভিক্টিমকে দোষ দিয়ে, অভিযোগ শুনে নীরব থাকা কর্তৃপক্ষকেও নড়ে চড়ে উঠতে দেখেছি। তবে কি বছরের পর বছর চলা সমস্যা সমাধানে একটি সুষ্ঠু বিচারই যথেষ্ট? 

তাই লক্ষ্য রাখতে হবে বিচারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাও যেন আমরা করে দিতে পারি। নতুবা এত বছর পর যেদিকে সামান্য বিচার পাওয়া যায় সেদিকেই ছুটবে সবাই। অনৈতিকতার খবর যেহেতু কেউই এতদিন রাখেনি।   

তথ্যসূত্রঃ
(১) https://www.researchgate.net/publication/350847245_Sexual_Harassment_of_University_Students_in_Bangladesh_A_Case_on_Dhaka_University
(২) নীতিগুলো তৈরিতে সাহায্য নেয়া হয়েছে যেসব কন্টেন্ট থেকে-
ক) https://www.cdc.gov/violenceprevention/pdf/campussvprevention.pdf
খ) https://www.dhakatribune.com/opinion/special/2019/04/13/sexual-abuse-in-educational-institutions-a-dangerous-trend-on-the-rise
গ) https://carleton.ca/secretariat/wp-content/uploads/Sexual-Violence-Policy.pdf 

Leave a Comment

Scroll to Top