চট্টগ্রামের আবাসন সংকট ও বস্তি সমস্যা

লিখেছেনঃ রাফিদ মোহাম্মদ ইশরাক, চট্টেশ্বরী রোড, চট্টগ্রাম থেকে

বাংলাদেশের প্রত্যেকটা শহরের একটা চেনা পরিচিত দিক হল “বস্তি”। একটা বস্তি গড়ে উঠে গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে শহরে আসা অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের ভীড়ে। শহরগুলো সংগত কারণেই গ্রামের চেয়ে বেশী কাজের সুযোগ তৈরি করে, যার কারণে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ শহরের দিকে পা বাড়ায়। আর এই প্রক্রিয়ার ফলেই শহরে একটা বিরাট আবাসন সংকট তৈরি হয়,  যার দরুন শহরের কেন্দ্রগুলোত আশে পাশে শত শত অবৈধ আবাসিক স্থাপনা গড়ে উঠে, কোন পৌর সুযোগ সুবিধা ছাড়াই। ঠিক এসব কারণেই চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানেও একাধিক বস্তি গড়ে উঠেছে। আবাসন সংকট আর বস্তি সমস্যা চট্টগ্রামের জন্য একটা নিজসে রুপ ধারণ করেছে শহরটি নিচু প্লাবন ভুমিতে অবস্থিত আর আশেপাশে পাহাড় দ্বারা বেষ্ঠিত হবার কারণে। এই নির্দিষ্ট ভৌগলিক বৈশিষ্টই চট্টগ্রাম এর বস্তি সমস্যাকে দিয়েছে একটা অনন্য রঙ।

কেন চট্টগ্রামে বস্তি গড়ে উঠেছে? 

গ্রাম থেকে শহরমুখী যাত্রা এর একটা প্রধান কারন। দ্রুত নগরায়ন  আর গ্রামীণ অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একাংশ তাদের পরিবার সমেত শহরে আসতে বাধ্য হয়, কিন্তু অনেক সময় নিজেদের খুঁজে পায় শহরে তার মত আরো হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে,  কর্মহীন অবস্থায়। এই অবস্তগা তাকে বাধ্য করে কম খরচে বসবাসের স্থান জোগাড় করতে- বস্তিগুলোতে।

প্রবৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ,  দ্রুত শহরের অর্থনৈতিক চেহারা পাল্টানোর কারণে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নগর পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ সময়ের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে শহরের নিম্নবিত্তের মানুষকে,  গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত বস্তি।

সাশ্রয়ী বসতির অভাবে আর সঠিক নগর পরিকল্পনার অভাব বস্তি গড়ে ওঠার জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পরিকল্পনা গুলো বাস্তবায়নের জন্য অর্থের অভাব আর সরকারী সমন্বয়হীনতাও এর পেছনে বিরাট প্রভাব ফেলে।

সময়সাপেক্ষ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা,  দুর্নীতি,  চাকরির অভাব – এই সবকিছুই প্রভাবে শহরে ইনফরমাল ইকনোমি গড়ে উঠেছে, যা গ্রাম থেকে শহরমুখী যাত্রার হার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

বস্তির বৈশিষ্ট্য ও প্রভাবঃ

অপর্যাপ্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচার, অস্থায়ী বসতভিটা,  ন্যুনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব।

দলিল, চুক্তিপত্রের সম্পুর্ণ অনুপস্থিতি,  আইনি রক্ষাকবচের অভাব

নিম্নমানের আবাসস্থল ও ঘনবসতি 

নিয়মিত পানি ওঠা, পয়ঃনিষ্কাশন এর অনুপস্থিতি – বর্ষাকালে যা প্রকট আকার ধারণ করে।

পাহাড় কেটে যেসব বস্তি গড়ে উঠে, সেগুলা বস্তিবাসীদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় কেননা, পাহাড়ের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা বস্তি প্রতি বছর বর্ষায় পাহারধষ এর শিকার হয়। এসব অপরিকল্পিত বস্তির জন্য মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হয়।

পুষ্টিহীনতা,  নিরাপত্তার অভাব, ইনফরমাল ইকনোমি, বেকারত্ব। 


নিরসনের উপায়ঃ

বস্তিবাসীদের মাঝে তাদের প্রাপ্য অধিকার,  প্রয়োজন ও ক্ষমতার ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলা।

বস্তি উচ্ছেদ না করে বস্তিগুলোর মধ্যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পৌছে দেয়া। বস্তি উচ্ছেদ কখনোই আবাসন সংকট এর উত্তর হতে পারে না, কারণ বস্তি উন্নয়ন বস্তি উচ্ছেদ এর চেয়ে সাশ্রয়ী,  টেকসই আর জনবান্ধব।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ এর মাধ্যমে বস্তি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা, তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, বস্তিবাসীদের অন্যত্র রিলোকেশন ও কোন সমাধান নয়, অতীতে এগুলো নিম্নবর্গের মানুষের জীবন যাত্রায় কোন ভালো প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে।

বস্তি উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অবশ্যই স্থানীয় বাসিন্দাদের ও বস্তিবাসীকে অঅন্তর্ভুক্ত করা।

আইনি সুযোগ সুবিধা বস্তিবাসী দের দোরগোড়ায় পৌছে দেয়া, জমির ও বসতভিটার ম্যাপিং করা, ফাইন্যান্সিয়াল এসিস্ট্যান্স( লোন, ইন্স্যুরেন্স) এর ব্যবস্থা করা,  দলিল ও চুক্তিপত্র আবশ্যিক করা। এর মাধ্যমে বস্তিবাসী অন্যদের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহি হবে।

উপসংহারঃ

আমাদেরকে বস্তি উচ্ছেদ এর নামে নিম্নবিত্ত নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। বস্তি উচ্ছেদ আর রিলোকেশন প্রজেক্ট কখনোই বস্তিবাসীদের সমস্যা সমাধান করে না বরং শহরে  নতুন আবাসন সংকট এর সৃষ্টি করে, এটা একটা চক্রের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে। সিডিএ, চউক আর একনেক কে আরো সহানুভূতির আর দায়িত্বশীল দৃষ্টি থেকে নিম্নার মধ্যবিত্তের আবাসন সংকট এবং বস্তি সমস্যাকে দেখতে হবে। এককেন্দ্রিক আমলাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং বস্তিবাসীদেরকে অবশ্যই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অর্থবহ ক্ষমতা দিতে হবে। কারণ তারাই জানে তাদের প্রয়োজন কী- সাশ্রয়ী ও পর্যাপ্ত  আবাসন, ন্যুনতম নাগরিক সুবিধা, লিগাল রিকগ্নিশন।

Leave a Comment

Scroll to Top