তথাকথিত উন্নয়ন নাকি প্রশ্নবিদ্ধ অস্বস্তি?

লিখেছেনঃ ওয়ানচি জেনি নকরেক, মধুপুর, টাঙাইল থেকে

মধুপুর গড় বা মধুপুর শালবন  বাংলাদেশের কেন্দ্রভাগে অবস্থিত একটি বৃহৎ বনভূমি বা উত্থিত এলাকা। গারো, কোচ, বর্মন ও বাঙালির বসবাস এখানে। মধুপুরের আদিবাসীদের ভূমিতে ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্প একটি দীর্ঘদিনের এবং আদিবাসীদের চলমান সমস্যা। 

১৯২৭ সালের উপনিবেশিক বন আইনের ৬ ধারার মাধ্যমে তৎকালীন ‘পূর্ববঙ্গীয় বন বিভাগ’ ১৯৫৫ সালে একটি ‘ফরেস্ট গেজেট’ প্রকাশ করে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের আমলে স্থানীয় গারোদের উচ্ছেদের জন্য ‘জাতীয় উদ্যান’ নাম দিয়ে ২০,৮২৭.৩৭ একর শালবনে তারের বেড়া দেওয়া হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য ‘সংরক্ষিত বন এলাকায়’ করা হয় ‘বম্বিং রেঞ্জ’। ১৯৮২ সালে ‘আটিয়া অধ্যাদেশের’ মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলার ৫৫,৪৭৬.৩৮ একর ভূমি ‘আটিয়া সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষিত হয়। এর ভেতরেই গারো গ্রাম উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক শালবনে তৈরি হয় বিমান বাহিনীর ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮৪ সালে মধুপুর বনে বসবাসরত গারো- কোচদের বন বিভাগ আবার উচ্ছেদ নোটিশ দেয়। ১৯৮৯-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের টাকায় টিএনডিপি’র সাড়ে সাত হাজার একর উডলট ও এগ্রোফরেস্ট্রি বাগান করার ফলে অনেক গারো আপন জায়গা-জমিন হারায়। ২০০০ সাল থেকেই শালবনের ৩০০০ একর কোর এলাকাকে ৬১,০০০ রানিং ফুট দেয়াল দিয়ে ঘিরে বিতর্কিত ‘ইকোট্যুরিজম প্রকল্প’ শুরু হয়। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্কবিরোধী মিছিলে বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পীরেন স্নাল। ২০১৬ সনে আবারও অরণখোলা মৌজার ৯১৪৫.০৭ একর ভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। আর শুধু এই মৌজাতেই আছে কয়েক শত বছরের প্রাচীন ১৩টি গারো গ্রাম। , পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেশের সংরক্ষিত বনভূমি দখলদারদের তালিকা তৈরি করে এবং ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারির ভেতর সবাইকে উচ্ছেদ নোটিশ পাঠায়।গারো-কোচদের পাশাপাশি এবার যুক্ত হয়েছে বাঙালিরাও। কারণ এখন মধুপুর শালবনে বাইরে থেকে আসা নয়াবসতিস্থাপনকারী বাঙালিরাই সংখ্যায় বেশি। এদের বড় অংশই কোনো বৃহৎ উন্নয়নপ্রকল্প বা নদীভাঙনে নিজেদের বসত হারিয়ে এই মধুপুরে নানা গ্রামে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের’ সমন্বয়ে আবারও ‘সংরক্ষিত বনভূমি উদ্ধারের’ বন বিভাগের সাম্প্রতিক এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে আন্দোলন।২০০৭ সালে দখলকৃত বনভূমি ‘উদ্ধারের’ নামে একের পর এক কলাবাগান কেটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। বন বিভাগ মোড়ে মোড়ে সাইনবোর্ড টাঙায় ‘কলাচাষ পরিবেশ ধ্বংস করে। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পেগামারি গ্রামের বাসন্তী রেমা ও গেটিস যেত্রা পরিবারের ৫০ শতক জমির পাঁচ শতাধিক শবরী কলাগাছ কেটে ফেলে বন বিভাগ। টাঙ্গাইল বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক জামাল হোসেন তালুকদারের নেতৃত্বে ‘বনভূমি’ উদ্ধারের নামে এই বিনাশ চলে। কলাবাগান কেটে বন বিভাগের লোকজন সেখানে আগ্রাসী একাশিয়া চারা লাগাতে চেয়েছিল।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেড’ ২০১৭ থেকে ২০১৮ মধুপুরের ৪৪টি গ্রামের ১১ হাজার ৪৮ পরিবারের ওপর একটি জরিপ করে। দেখা যায়, ৪৪টি গ্রামে গারো ও বাঙালি মিলিয়ে জনসংখ্যা ৪৭ হাজার ৭২৬। এর ভেতর ৬৪.৬১ শতাংশ বাঙালি এবং গারো ৩৫.৩৯ শতাংশ। ১৯৫১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নের জনসংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৮০০ জন এবং এদের প্রায় সবাই ছিলেন গারো ও কিছু কোচ জনগোষ্ঠী। ২০১৭ সালে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের এক সুবিশাল জরিপে দেখা যায়, অরণখোলা, আউশনারা ও শোলাকুড়ি ইউনিয়নে ১২৬টি গ্রামের ভেতর আদিবাসী গ্রাম ৪৯ এবং বাঙালি গ্রাম ৭৭। বন বিভাগ ঘোষিত সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর আদিবাসীদের ১৬২৮.২৬ একর চালা এবং ৪৪৭.২৭ একর নামা জমি মিলিয়ে মোট ২০৭৫.৫৩ একর জমি পড়েছে। সংরক্ষিত বনভূমির ভেতর ৫৬৫৯ জন আদিবাসী এবং ৩০০৩ জন বাঙালির বসতভিটা ও কৃষিজমি পড়েছে।

টাঙাইলের মধুপুর গড়ে গারো-কোচদের ভূমির অধিকার ও উচ্ছেদ না করার দাবিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ-অবরোধের মাধ্যমে প্রতিবাদ করা হলেও এখনও পর্যন্ত যুক্তিযুক্ত কোনো সমাধান মেলেনি। চলমান প্রকল্প বন্ধসহ মধুপুর আদিবাসী অঞ্চলের সকল ধরণের ইকো-ট্যুরিজম বন্ধ এবং অনতিবিলম্বে এ সমস্যা সমাধান কল্পে গত ৯ই মে মধুপুরের বিক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতার ব্যানারে জলছত্রের প্রধান সড়কের ওপর মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচী পালন করে। মানববন্ধনে সকল ছাত্র সংগঠন, এলাকার আদিবাসী জনতা এবং অন্যান্য মানবতাবাদী আদিবাসী সংগঠন একযোগে সংহতি প্রকাশ করে। সেদিনের মানববন্ধন ও স্মারকলিপিতে তাঁদের দাবীসমূহ যেমন-

* টেলকী গ্রামে তথাকথিত আরবোরেটুম/উদ্ভিদ সংরক্ষণ উদ্যানের নামে আদিবাসীদের পূর্বপুরুষদের বিদ্যমান প্রাচীন সামাজিক কবরস্থান/শশ্মান (মাংরুদাম) এর স্থানে প্রাচীর নির্মান, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনাসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন অবিলম্বে বন্ধ করা।

* চলমান প্রকল্প এলাকা ও তৎসংলগ্ন স্থানীয় আদিবাসীদের স্বত্বদখলীয় কৃষি ও ফসলি (বাইদ/চালা) জমিতে কোন ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা।

* জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা বাতিল করে মধুপুরে স্থানীয় আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।

* আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান ও সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন দ্রত গঠন করা।

টাঙাইলের মধুপুর গড়ের এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্যে আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। 

তথ্যসূত্রঃ মধুপুর শালবনের সপক্ষে-পাভেল পার্থ, মধুপুরের আরবোরেটুম স্থাপনা উদ্বোধন ইকো-ট্যুরিজম-লুই সাংমা,  ইন্টারনেট।

Leave a Comment

Scroll to Top