লাইলী বেগম – একাত্তর থেকে একুশে : সুবর্ণ উচ্চারণ

“ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করছি। অথচ যুদ্ধের পর পর এই সমাজ আমারে শুধু ঘেন্না করেছে। আমাদেরকে খানকি ছাড়া কেউ কিছু কয় নাই। আমরা যদি রাস্তা দিয়া হাইটা যাইতাম তো মাইনষে চোখ ঢাইকা রাখছে। তার জন্য দেশ-গ্রাম ছাইড়া আমরা ঢাকায় চইলা আইছি। “
যেই স্বাধীন দেশে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি আমি-আপনি, সেই স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে মিশে আছে লাখো বীরাঙ্গনার নীরব আর্তনাদ, অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাস। তেমনই একজন বীরাঙ্গনা লাইলী বেগম, তারই মুখের কথাগুলো সরাসরি তুলে ধরলাম শুরুতেই। যাদের আওয়াজকে এতকাল ধরে স্বাধীন দেশের সভ্য সমাজ শুনতেই চায়নি, তার কথায় আরো কাটছাট করি কী করে!
লাইলী বেগমের জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া থানার ঘাগর ইউনিয়নের একটি গ্রামে। তার বাবার নাম শামসুল হক ও মা গোলাপী বেগম। রিকশাচালক বাবার একার উপার্জনের উপর নির্ভর ছিলো তাদের ৫ ভাইবোনের সংসার। তাই বাবার ভার কিছুটা লাঘব করার জন্যই পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব নেয়ার পাশাপাশি লোকের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন তিনি। এসবের মধ্যেও তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। এরপরই তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে হয়ে গেলেও তখনও অনুষ্ঠান করে তাকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যায়নি তার স্বামী, বাবা-মায়ের সাথে খুলনাতেই থাকতেন তখন তিনি। রণদামামা বাজিয়ে যখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলে আসে তখন ১৬/১৭ বছর বয়সী লাইলী বেগম ৪ মাসের গর্ভবতী।
২৫শে মার্চ ঢাকার পাশাপাশি খুলনা শহরেও গোলাগুলি শুরু হয়ে যাওয়ায় লাইলী বেগম ও তার পরিবার বুঝতে পারে যে খুলনা আর তাদের জন্য নিরাপদ নয়। ব্যাস! যৎকিঞ্চিৎ চিড়া,মুড়ি, শুকনো খাবার নিয়ে শুরু হয় দেশের বাড়ি কোটালিপাড়ার দিকে তাদের অনিশ্চিত যাত্রা। মনের মধ্যে একটি ক্ষীণ আশা ছিলো যে হয়তো পাকহানাদাররা নদী পেরিয়ে গ্রামগঞ্জে যেতে পারেনি এখনো। কিন্তু গ্রামে গিয়ে বোঝেন, সর্বগ্রাসী আগুন এখানেও ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুদিন সেখানে তার নানাবাড়িতে আত্মগোপন করে থাকার পরই ঘটে চরম বিপত্তি। নানাবাড়ি থেকেই পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় লাইলী বেগমকে, এক অশুভ অন্ধকার নেমে আসে তার জীবনে।
লাইলী বেগমকে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে প্রায় দেড় মাস আটক থাকতে হয়েছিলো,গোপালগঞ্জের বিভিন্ন ক্যাম্পেই রাখা হয়েছিলো তাকে। সেই ক্যাম্পগুলোতেই তিনি সহ্য করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। ক্যাম্পের বন্দিনীদের যখন যেভাবে মর্জি সেভাবেই নির্যাতন করেছে পাকিস্তানি পিশাচরা। বারবার যেমন ধর্ষণ করেছে, তার পাশাপাশি শারিরীক নির্যাতনও চলেছে। বাধা দিয়েছিলেন বলে লাইলী বেগমের উপর বেয়নেট চার্জও করা হয়েছিলো ক্যাম্পে। ঠিকমতো খাবারও দেয়া হতো না বন্দিনীদের। একে তো এমন বর্বরোচিত নির্যাতন, তার উপর অপুষ্টি- গর্ভবতী লাইলী বেগমের সন্তানটি আর পৃথিবীর আলো দেখেনি।
বাঁচার ইচ্ছে মরে গিয়েছিলো তার, বাঁচার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন – এমন সময় তাদের সন্ধান পেয়ে হেমায়েত বাহিনী পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আক্রমণ করে। সে সময়ে অপহৃত বীরাঙ্গনারা ক্যাম্প থেকে দৌঁড়ে পালান। পালানোর সময় তাদেরকে পেছন থেকে গুলি করে কাপুরুষরা, সেই চিহ্ন এখনো উরুতে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বন্দীজীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি হেমায়েত বাহিনীর সাথে যোগ দেন। তাদের সাথে সম্মুখ সমরে যেমন গিয়েছেন, তেমনি আহতদের সেবাশুশ্রুষাও করেছেন, পাকসেনাদের চোখ এড়িয়ে মুক্তিসেনাদের কাছে অস্ত্রও পৌঁছে দিয়েছেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি ভারতের শরণার্থী শিবিরে চলে যান, যুদ্ধ শেষে আবার শরণার্থীদের সাথে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন তিনি।
স্বাধীন দেশে ফিরছিলেন, নি:সন্দেহে অনেক স্বপ্ন-আশা ছিলো তার মনে। কিন্তু এদেশের নির্মম সমাজবাস্তবতার কঠোর আঘাতে তার সমস্ত আশা নিরাশায় পরিণত হয় খুব তাড়াতাড়ি। তার মায়ের পক্ষ থেকে কোনোরকম অবজ্ঞা না পেলেও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে আর কখনোই মেনে নিতে পারেনি, উপরন্তু তার স্বামীকেও প্ররোচিত করতে থাকে তাকে তালাক দিয়ে দেয়ার জন্য। প্রাথমিক অবস্থায় তার স্বামী নিজের পরিবারকে ত্যাগ করে তার সাথে এসে থাকতে শুরু করে। তবে স্বামীও তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি আর। স্বামীর কাছ থেকে প্রতিনিয়ত গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছিলো তার। প্রতিবাদ করলে স্বামী তার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতো। এরই মধ্যে তার ৩ কন্যার জন্ম হয়। কিন্তু স্বামী আবার আরেকজনকে বিয়ে করেন, একসময় তারও মৃত্যু হয়।
এরপরের সংগ্রামটা লাইলী বেগমের জন্য আরো কঠিন, আরো কণ্টকাকীর্ণ। কোনো সহায়-সম্পদ ছিলো না, রিলিফের খাবারই ভরসা। তাই দিয়েই মেয়েদেরকে বড় করেন তিনি। বড় ও মেজ মেয়েকে যথাক্রমে ৫ম ও ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন, আর ছোট মেয়েটি বর্তমানে জজকোর্টে ওকালতি করে। সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়ে কাউকে তার বীরাঙ্গনা পরিচয়ের কথা জানাতে পারেননি, মেয়েরাও তাকে বারণ করেছিলো জানাতে।কিন্তু ২০১৪ সালে তিনি শেষমেশ পান মুক্তিযোদ্ধার সম্মান ।
একে একে স্বাধীনতার ৫০টি বছর পেরিয়ে গেছে। লাইলী বেগমেরও এখন বয়স হয়েছে, বার্ধক্যের সাথে এসে জুড়েছে নানা ধরণের রোগশোক। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পেয়েছেন, কিন্তু কোনো ভাতা পাননি, মেয়েরাই এখন তার দেখাশোনা করে। তাও সারাজীবন অপমান পেয়ে আসা লাইলী বেগম এখন একটু সম্মান পেয়ে সত্যিই আশায় বুক বাঁধেন। আশা করেন, রাষ্ট্রের সহযোগিতায় যেন কোনোরকমে জীবনের বাকি দিনগুলো অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান হয়ে যায়, যেন স্বাধীন দেশের পতাকা বুকে নিয়ে প্রিয় বাংলাদেশেই স্বস্তিতে শেষ নি:শ্বাস ফেলতে পারেন।
তথ্যসূত্র: “বীরাঙ্গনার আত্মকথন”- ড. শেখ আবদুস সালাম, শিল্পী বেগম
ক্রিয়েটিভ কৃতজ্ঞতা: ওয়াহিব অমিও
লেখা: সুবাহ বিনতে আহসান

Leave a Comment

Scroll to Top