মোকলেসা বেগম – একাত্তর থেকে একুশে : সুবর্ণ উচ্চারণ

১৯৭১। পূর্ব বাংলার উত্তরাঞ্চলের ঠাকুরগাঁও মহকুমা। যুদ্ধ শুরু হয়েছে, অনেক বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে গেছে মুক্তিসেনারা। মোকলেসা বেগম তখন গৃহবধূ, পাঁচ সন্তানের জননী। সংসার সামলানোই জীবনের ধ্যান জ্ঞান। গ্রামের সকলের মত তিনিও শঙ্কায় আছেন, যেকোনো সময় হানা দিতে পারে হানাদার বাহিনী,স্বামী সন্তান, শ্বশুর শাশুড়ি সকলকে নিয়ে চিন্তিত। আদরের সন্তান বা স্বামী কাউকে হারাতে রাজি নন তিনি। বিভিন্ন গ্রামে হানা দিচ্ছে পাক সেনারা, পরিবারের জানের ভয়ে প্রায়শই ভীত সন্ত্রস্ত থাকেন তিনি। শুনেছেন বিভিন্ন গ্রামে অল্পবয়সী মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে এই ভিনদেশী হানাদার গোষ্ঠী। নিজের মেয়েদের নিয়ে তিনি চিন্তিত।

মোকলেসা বেগম জানতেন না, কল্পনাও করেননি হানাদার বাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়া মহিলাদের কাতারে তিনিও থাকবেন। সেদিন রাতে পাক সেনারা বাড়ি বাড়ি গিইয়ে হানা দেয় এবং তুলে নিয়ে যায় মহিলাদের। চুল ধরে টেনে মারতে মারতে ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে নিয়ে যাওয়া হয় মোকলেসাকে। জ্ঞান ফিরলে মোকলেসা দেখতে পান একটি কামরায় বাইশ জন মহিলা বন্দী, সকলের শরীরে পরনের কাপড়ের ঠিক নেই, তাদের মধ্যে আছেন তাঁর বোনও।

অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হতে হয় তাদেরকে। একের পর এক ধর্ষণ করতে থাকে পাকি সেনাদের দল। পাহাড়ের মত নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিলেন মোকলেসা। যন্ত্রণায় চিৎকার করার শক্তিটুকুও তার ছিল না। এই বর্ণনা যতবার বলতে হয়েছে তাকে, থরথর করে কাঁপতেন তিনি, রাতে বারবার সেইদিনের কথা স্বপ্নে দেখে ভয়ে জেগে উঠতেন।
যুদ্ধকালীন এই অত্যাচারের মত যুদ্ধোত্তর মানসিক অত্যাচারও পোহাতে হয়েছে তাকে সারা জীবন, কিন্তু তা দেশের মানুষের কাছ থেকেই।সারাটা জীবন তিনি নিজেকে কলঙ্কিত মনে করে গেছেন। গণধরষনের সেই ঘটনার পর পর চার মাস যাবত মোকলেসা বেগমের স্বামী আশেপাশে আসতেন না, তার হাতের রান্না, পানি খেতেন না। একমাত্র শ্বশুর এবং গ্রামের কতিপয় মুরুব্বিরা তার প্রতি স্নেহ, সহানুভূতি ও সম্মান পোষণ করেছিলেন। এছাড়া গ্রাম ও পরিবারের অধিকাংশ মানুষ তাকে গালি দিয়ে সম্বোধন করতেন। কেউ তাকে রাস্তায় যেতে দেখলেই বলত, “নষ্ট মহিলা যাচ্ছে”। বাড়ির উঠোনে কাজ করবার সময় গ্রামের অনেক পুরুষ কাছে এসে কুৎসিত ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। “বিদেশীদেরকে তাঁর শরীর উপভোগের সুযোগ দিয়েছে, স্বদেশদেরকেও যেন সে সুযোগ দেয়, উঠতে বসতে এমন কথা শুনতে হয়েছে তাকে।

সন্তানরা বড় হওয়ার পর তাদের থেকে কিছুটা মানসিক শক্তি পেয়েছিলেন মোকলেসা। কোনো সরকারের আমলেই যথার্থ সম্মাননা পাননি তিনি। এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “আকাশটা যত বড়, তার চেয়েও বেশি বড় মনে হয় আমার মন। সে পরিমাণ দুঃখ কষ্ট ক্ষোভ জমা আছে এই মনের মধ্যে। অনেক চেষ্টা করেছি সব মুছে ফেলতে, কিন্তু ভুলতে পারিনাই।”

মোকলেসার বাড়ির পাশেই রয়েছে খুনিয়া দিঘী। যেই দিঘীতে গণহত্যা করেছিল পাকবাহিনী। সেই হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন মোকলেসার বাবা মা ভাইও। বলা হয়, দীর্ঘদিন যাবত দীঘি ছিল রক্তের পানিতে লাল। লাশ ভেসে ভেসে উঠত সেখানে। হারানো পরিবারএর স্মৃতিচারণ করতে দিঘীর পাশে গিয়ে বসে থকতেন মোকলেসা।

“আপনারা ইতিহাস লিখতে চাইলে লিখতে পারেন, আমার কথাও শেষ হবে না, আপনার লেখাও শেষ হবে না। একাত্তর আমার জীবনে অভিশাপ ছিল। এটাই আমার শেষ কথা”। ২০১৬ সালের ৩০ জুন প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে “মুক্তিযোদ্ধা” সম্মানী ভাতার তালিকায় তার নাম আসলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো সুযোগ সুবিধা লাভের সৌভাগ্য তার হয়নি। তা বাস্তবায়নের পূর্বেই ৪৫ বছর ধরে অন্তরে জমানো সকল দুঃখ ও ক্ষোভ নিয়ে ওই বছরেরই ২০ অক্টোবর তিনি যাত্রা করেন পরলোকে।

লেখাঃ পূর্বাশা পৃথ্বী

ক্রিয়েটিভঃ ওয়াহিব অমিও

তথ্যসূত্রঃ
১। জাহিদ স (2013). ১৯৭১ সম্ভ্রম হারানো নারীদের করুণ কাহিনী. অন্বেষা প্রকাশন.
২। ডেস্কব. (2019, November 6). সরব হচ্ছেন বীরাঙ্গনারা. Bangla Tribune.
৩। “We lay like corpses”: Bangladesh’s 1970s rape camp survivors speak out. (2019, November 5). The Guardian.
৪। পত্র ব. (2016, October 22). রাণীশংকৈলে বিরঙ্গণা মোকলেসার মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত.

Leave a Comment

Scroll to Top